যাহা বায়ান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন -বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন byমুশফিক মান্নান চৌধুরী

শর্তসাপেক্ষে শাখা ক্যাম্পাস ও দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখে মন্ত্রিসভায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সম্প্র্রতি অনুমোদিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আইনটিকে যদি কেউ ‘যাহা বায়ান্ন, তাহাই তিপান্ন’ বলে অভিহিত করে, তাহলে দোষ দেব কাকে?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে শিক্ষা-বাণিজ্য, আর এই বাণিজ্যের প্রধান বাহন বা বিপণিকেন্দ্র হচ্ছে এর শাখা বা আউটার ক্যাম্পাস এবং দূরশিক্ষণ কার্যক্রম।
১৯৯২ সালের প্রথম আইন এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালে সংশোধিত আইনে দূরশিক্ষণ ও শাখা ক্যাম্পাসের প্রসঙ্গ ছিল না। তারপরও অনুমতি ছাড়া এবং আইন অমান্য করে এমন শিক্ষা চালুর মাধ্যমে বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা বিতর্কিত করে তোলা হয়। ২০০৭ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ ধরনের শিক্ষা অবৈধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। এর পরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আইনের আশ্রয় নিয়ে বা গায়ের জোরে অবৈধ শাখা পরিচালনা করে যাচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রণীত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে শাখা ক্যাম্পাস ও দূরশিক্ষা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিষয়টি ছিল মেঘ না চাইতেই জলের মতো বিষয়। ওই অধ্যাদেশ জাতীয় সংসদ গ্রহণ করেনি। ধারণা করা হচ্ছিল, এবারের আইন থেকে দূরশিক্ষণ, শাখা ক্যাম্পাস ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখার প্রসঙ্গ বাদ যাবে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ না চাইলেও সেটি বাদ যায়নি। এ প্রসঙ্গে শিক্ষা কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমে বলছে, আইনে এসব বিষয় থাকলেও প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত দিন আইনে ছিল না, তারপরও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রা ঠেকানো যায়নি। এবার আইনে উল্লেখ থাকায় এক ধরনের বৈধতা এল। যেখানে আইন কেউ মানতে চায় না, সেখানে নীতি দিয়ে এটা কতটা ঠেকানো যাবে, সেটা দেখার বিষয়।
গত বছর প্রথম আলো ‘উচ্চশিক্ষার ফেরিওয়ালা’ শিরোনামে বেশ কয়েকটি পর্বে দূরশিক্ষণ ও আউটার ক্যাম্পাস কার্যক্রমের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। সরেজমিন ওই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শাখা ক্যাম্পাস ও দূরশিক্ষা কার্যক্রমের কারণেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ শতাংশ বদনাম হচ্ছে।
প্রথম আলোর (২২ অক্টোবর) জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৬১ দশমিক ৪৬ ভাগ উত্তরদাতা এই শাখা ক্যাম্পাস ও দূরশিক্ষণের বিরোধী। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করা গেল, শর্তসাপেক্ষে কথাটা জুড়ে দিয়ে এই শিক্ষার বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।
শাখা ক্যাম্পাস বা দূরশিক্ষণের শর্তাবলি পালন করতে বিপুল অঙ্কের আর্থিক সংগতি প্রয়োজন। এই সংগতি ইতিমধ্যে আইন অমান্যকারীরা অর্জন করে রেখেছেন। তাঁদের কেউ কেউ দেশের প্রতিটি জেলায় এমনকি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষায় মাছবাজারের পেছনেও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে শাখা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তাঁদের অনেকের আয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ, ব্যয় হয়েছে যত্সামান্য। তার একাংশ হয়েছে দালালের পেছনে, একাংশ খরচ হয়েছে মুখ বন্ধ করার কাজে আর একাংশ ব্যয় হয়েছে সনদ মুদ্রণ বাবদ। এই শর্তসাপেক্ষ কথাটি জুড়ে দিয়ে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এবার তারা গাছেরটা খেয়ে তলারটাও কুড়াবে। আর কেউ যদি ভেবে থাকেন নতুন আইনে নবাগতরা ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করবে, তাদের আশায় গুড়ে বালি। নতুন আইনটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আইনটি মুষ্টিমেয় স্থানীয় রাঘববোয়াল কিংবা নামসর্বস্ব বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপ্রবেশের জন্য করা হয়েছে।
কতিপয় ক্ষমতাবানের একগুঁয়েমি, কতিপয় সুবিধাভোগীর স্বার্থান্ধতা এবং কিছু ব্যক্তির অদূরদর্শিতা কখনো কখনো মহত্ উদ্যোগকে বিনষ্ট করে দিতে পারে, তার প্রমাণ এই আইনের ফাঁকফোকরে আছে। জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার আগে আইনটির বেশ কিছু সংস্কার প্রয়োজন। নইলে সমালোচনার গণ্ডি থেকে বের হতে পারবে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা।
ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.