এই আনন্দ অনিঃশেষ হোক by আনিসুল হক

কী ভীষণ ভরভরন্ত ছিল নদীটা। বাড়ির গা ঘেঁষে বইত। বর্ষাকালে পানি চলে আসত উঠোন পর্যন্ত। তখন যেদিকে তাকাও শুধু পানি আর পানি। কলার ভেলা বা নৌকা ছাড়া ঘর থেকে এক পা ফেলার উপায় নেই। তবুও উত্সাহ-উদ্দীপনার অভাব নেই মানুষজনের। পোলো পাতা হয়েছে, তাতে ধরা পড়ছে বড় বড় মাছ, সামনের ডোবায় পাটের জাগ দেওয়া হয়েছে, কাজের কি আর সুমার আছে। বাড়িভর্তি লোকজন। দুটো সুন্দর কাঠের কারুকাজ করা ঘর, একটা গোলাঘর, বাঁশের মাচানের ওপর, তাতে ধানচাল-ডালের স্তূপ। গোয়াল ভরা গরু। বন্যার পানি একসময় নেমে যায়। ধান ওঠে। ঢেঁকিতে তখন ঢ্যাম কুর কুর শব্দ। শ্বশুর সাহেব নিজের ঘরে জলচৌকিতে বসে আছেন, সামনে কাঁসার থালা, গরম গরম পিঠা আসছে। ছেলেপুলেদের পাতে গরম ঘন দুধ, খইয়ের মুড়কি। আম আনতে হতো গরুগাড়ি করে, একজন বসছে এক ডালা আম নিয়ে, হাতের কনুই বেয়ে রস ঝরছে। শীতকালে গুড় বানানোর কল ঘুরছে, গরম গরম গুড় নামছে, কলার ঢালের থালায় চ্যাংটা গুড় নিয়ে মুখে তুলতেই সারা হাত মাখামাখি। পুরো বাড়িতে মানুষজন গমগম করছে। সেই নদী মরে গেছে। সরে গেছে দূরে। বাড়ির সামনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ। মেয়েরা বড় হয়েছে, বিয়ের পরে তারা চলে গেছে দূরদূরান্তরে। ছেলেরাও বড় হলো, তারা সব চলে গেল শহরে। বাড়ির গিন্নি আর বাড়ির কর্তা। দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকেন বিশাল বাড়িটিতে। একদিন মিয়া সাহেবও চলে গেলেন। বৃদ্ধা একা। সমস্ত বাড়ি তিনি পাহারা দেন। সারা রাত ঝরে পড়া পাতা সর সর শব্দ তোলে উঠোনে। বাঁশবনে শেয়াল ডাকে। পাল্লা দিয়ে ডাকে কুকুর।
গোয়াল আছে, গোয়ালে অত গরু নেই। দেখবে কে? প্রয়োজনটাই বা কী! পাকাঘর উঠেছে, বিদু্যুত্ এসেছে বাড়িতে, বন্যার জলও আর ঢোকে না উঠোনে, শুধু বাড়ির মানুষগুলো সব শহরে, বাড়িটা ফাঁকা। বৃদ্ধা মা একা একা দাওয়ায় বসে অতীতের কথা ভাবেন।
শুধু ঈদের দিনগুলোয় আবার ভরে ওঠে বাড়িটা। ছেলেরা চলে আসে, বউ-বাচ্চা নিয়ে। কখনো কখনো আসে মেয়েরা। মায়ের বুকটা ভরে ওঠে।
এবার নাকি কেউ আসতে পারবে না। বড় ছেলের দুই মেয়েরই জ্বর। হাসপাতালে নিতে হয়েছে তাদের। মেজো বউয়ের বাচ্চা হবে। ছোটটা ব্যস্ত ঢাকায়, ঈদের নাটক নিয়ে।
মা দাওয়ায় বসে থাকেন। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে কখন। কাজের মেয়েটা কিছুক্ষণ বসে থেকে বারবার করে বলল, ‘দাদি আম্মা, তরকারি কী রান্ধমো?’ তিনি জবাব দেন না। কিসের খাওয়া, কিসের দাওয়া। ছেলেরাই যদি না আসে, বছর শেষে একটাবার ঘরদোর যদি আবার ভরে না ওঠে ছেলে-বউ, নাতি-নাতনির পদচারণে, কী হবে তাহলে এবার ঈদে।
বাংলাদেশের ঈদের এই এক আশ্চর্য দিক। সবাই ছুটে যায় নিজ নিজ উত্সভূমিতে। সংবাদপত্রে লেখা হয়, নাড়ির টানে। জন্মানোর পর আমাদের নাভিটা কেটে বাকি অংশটা নাকি পোঁতা হয় মাটিতে। তাই নাকি আমাদের এত জন্মভূমির প্রতি টান! কে জানে। কিন্তু এই যে পুরো ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যাবে, সবাই যাবে যে যার আদি ঠিকানায়, তার মধ্যে একটা গভীর মানবিক আবেদন আছে। শুধু সন্তানেরা তার বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলিত হয়, তাই নয়, পাড়া-পড়শি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবেরাও সব মিলিত হয় ঈদ উপলক্ষে। সবার সঙ্গে সবার দেখা হয়। কথা হয়।
শিরোনামহীন ব্যান্ডের একটা গানে একটা লাইন আছে, ‘শহর মানে গ্রামের গল্প’। ঈদে বাড়ি ফেরার এই মহামিছিল দেখলে সেই কথাটাই মনে হয়। আমাদের নেতারাও ফিরে যাবেন গ্রামে। সারাটা বছর শহরে থাকলেন, রাজধানীতে, জেলা শহরে, এবার যেতে হবে ভোটারদের কাছে। আবার সামনে ভোট তো একদিন আসবেই।
পৃথিবীতে আর কোথাও ঈদের আগে এই রাজধানী বা শহর ছেড়ে সারা দেশের বিশাল মানচিত্রে মানুষের ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখা যায় কি? ঈদে বা বড়দিনে? আমার জানা নেই। এ শুধু বাংলাদেশেই দেখা যায় বলে আমার ধারণা।
বাংলাদেশে ঈদ হয়ে উঠেছে আমাদের সৃজনশীলতা আর বিকিকিনির সবচেয়ে বড় উত্সব। ঈদ উপলক্ষে বেরুচ্ছে ঈদসংখ্যা, তাতে কত গল্প, কত উপন্যাস! অনেক বাজারি বা ফরমায়েশি লেখা থাকে, কিন্তু হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস আগুনপাখিও যে ঈদসংখ্যাতেই প্রথম বেরিয়েছিল, সেই কথাটাও মানতে হবে। টেলিভিশনগুলোয় ঈদ উপলক্ষে প্রচারিত হয় বিশেষ নাটক। গত বছর ‘মেরিল-প্রথম আলো’ পুরস্কার পাওয়া অমিতাভ রেজার একটা টেলিফোন করা যাবে, প্লিজ নাটকটাও তো ঈদ উপলক্ষেই প্রচারিত। কাজেই ঈদের সৃজনশীলতার মহোত্সব থেকেও আমরা পাই আমাদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলোও। ঈদে মুক্তি পায় নতুন নতুন চলচ্চিত্র, বাজারে আসে গানের অনেক অ্যালবাম।
আর ঈদ আসে আমাদের অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করতে। বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ এর মানুষ। এত মানুষ। সবাই এক জোড়া করে জুতা কিনলে ১৫ কোটি জোড়া জুতা বিক্রি হবে। ভাবা যায়! শাহাদত চৌধুরী সত্তরের দশকের শুরু থেকে তাঁর সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকায় চেষ্টা করেছিলেন দেশি ফ্যাশনকে জনপ্রিয় করে তুলতে। আজকে ঈদের বাজারে দেশি পণ্যের জয়জয়কার। টাঙ্গাইলের তাঁতিদের অনেকেই দোতলা বাড়ি তুলেছেন। দেশি পোশাক, দেশি নকশা। বাংলাদেশেরই জয়জয়কার।
আর মানুষ যে ঈদ উপলক্ষে মানুষকে উপহার দিচ্ছে, হূদয়ের সঙ্গে হূদয়ের বন্ধনটা ঝালাই করে নিচ্ছে মানুষ, সেটা দেখলে কী যে ভালো লাগে। হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ নেই এতে। আর এই যে ঈদ উদ্যাপনের বাংলাদেশি ধরনটা আমরা তৈরি করে নিয়েছি, তাতে কিন্তু সব ধর্ম, সব বর্ণের মানুষই যোগ দিতে পারছে। ভালো নাটকটা যে বানাচ্ছে, সে হিন্দু না মুসলিম, এই প্রশ্ন কোনো দিনও তোলেনি এই দেশের মানুষ, যখন গানের সিডি কিনি, তখন সবাই শিল্পীকে শিল্পী হিসেবেই দেখেন, তার ধর্ম-গোত্র পরিচয়ের কথা ভুলেও কারও মাথায় আসে না।
ঈদের বাণী কিন্তু সাম্যেরই বাণী। সমমর্মিতা আর সহমর্মিতার আবেদন নিয়েই ঈদ আসে। মানুষে মানুষে যেন কোনো বৈষম্য না থাকে, সেই কথাটা যেন আমরা ভুলে না যাই। এই সমাজে সবাই যেন খেতে পায়, পরতে পায়, সবাই যেন লেখাপড়ার সুযোগ পায়, সেই দিন আমাদের আনতেই হবে।
সেই কাজটা রাষ্ট্রের, সেই কর্মোদ্যোগে সবাইকে শামিল করতে পারেন রাষ্ট্রনায়কেরা।
তবে ব্যক্তি-মানুষও কিন্তু বসে নেই। মানুষ ছুটে যায় মানুষের কাছে। মানুষ হাত বাড়িয়ে ধরে মানুষের হাত। এই সমাজে কত মানুষ আছেন, কাউকে না জানিয়ে তারা অন্য মানুষের উপকার করে যাচ্ছেন, মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও তারা অকাতর।
এবার ঈদের পরপরই শারদীয় দুর্গোত্সব। এবার শরত্ এসেছে একটু দেরিতে, বিলম্বিত বর্ষার কারণে। তবু বাতাসে দেখতে পাই রোদের ঝলকানি। কাশফুলে ছেয়ে গেছে নদীতীর। এর মধ্যে বেজে উঠবে পূজার ঢাক।
দুই উত্সব মিলে উত্সবের বড় একটা মৌসুম তৈরি হলো বাংলাদেশে। ঈদের কদিন সেমাই খেয়ে পরপরই নাড়ু খাওয়ার আনন্দের উপলক্ষ এসে গেল বাংলার জনপদে জনপদে।
সংবাদপত্রে অবশ্য লেখা হচ্ছে বড় একটা ছুটির ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে দেশ। খুব বড় একটা ছুটির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে সরকারি অফিস-আদালত। তাতে যেন আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত না হয়। উত্পাদনশীলতায় ব্যাঘাত না ঘটে।
সরকারি অফিসগুলো বন্ধ থাকলে আমাদের ক্ষতি না লাভ, সেটা একবার টিআইবি হিসাব করে বলতে পারে। ওরা যেমন বলে বছরে কোন সেক্টরে কত টাকার দুর্নীতি হয়েছে, তেমনি এবার বলুক না, এই উত্সব উপলক্ষে দীর্ঘদিন সরকারি অফিস বন্ধ থাকায় এত টাকার ঘুষ কম খাওয়া হয়েছে!
বাংলাদেশের উত্সবের এই মিলনধর্মী উত্সমুখিন সংস্কৃতি আমার খুব ভালো লাগে। সুন্দর কাপড় পরা, ভালো খাওয়া-দাওয়া তো আছেই, তার সঙ্গে এই যে সৃজনশীলতার মহোত্সবটা যুক্ত হলো।
ছোটবেলায় স্কুলপাঠ্য কবিতায় পড়েছিলাম ঈদের বর্ণনা। কেউ যাবে না কারে ঠেলে, কেউ যাবে না কারেও ফেলে, অন্যে যদি দুঃখ পায়, খুশির কিছু নেই তাতে। অন্যকে দুঃখ দিয়ে নিজেকে কি খুশি রাখা যায়! ওই কবিতাতেই পড়েছিলাম, সবার দুয়ার খোলা আজি কোথাও নাই মানা, খাঞ্জা ভরে বিলাব আজ যত রকম খানা...স্মৃতি থেকে বলছি, কথাটা অন্য রকমও হতে পারে। তবে সবার দুয়ার খোলার একটা বাস্তব উদাহরণ হলো, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীরা যে তাঁদের দুয়ার খুলে দেন, প্রয়োজনীয় দেহ তল্লাশি শেষে অভ্যাগতরা, কখনো কখনো রবাহূতরাও তাদের খোলা দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে।
ঈদে সবচেয়ে মজা করে বাচ্চারা। এরপর? তা বলতে পারব না, কিন্তু এটা বলতে পারি, ঈদের ধকলটা সবচেয়ে বেশি যায় মহিলাদের ওপর দিয়ে। সাহেব তো নামাজ পড়ে ফিরে এসে ফুরফুরে পাঞ্জাবি গায়ে বারান্দায় বসে ঈদসংখ্যা পড়ছেন বা টিভি দেখছেন, আগের দিন মেলা রাত পর্যন্ত জেগে সেমাই রাঁধা ইত্যাদি সেরেছেন বাড়ির গিন্নিই, ঈদের দিন বা তার পরের কয়েকটা দিন একজনের পর একজন মেহমান আসবে, তাদের খেতে দাও, খাবার গরম রাখো, বাসনকোসন সামলাও। কাজ কি কম? তার পরও ওই মেয়েদেরই আনন্দ হয়তো বেশি, কারণ তারা আত্মত্যাগেই এখনো এই দেশে আনন্দ পান। ছেলেরা বাড়ি যাচ্ছে, সঙ্গে যাচ্ছে বউ, কিন্তু সে যে তার বাবা-মা-ভাইবোনের কথা মনে করবে ঈদের দিনে, সেইটা কে ভাববে! ভাগ্যিস মোবাইল ফোন আছে!
যে একাকী বয়স্ক নারীর কথা বলে শুরু করেছিলাম, তার কথা দিয়েই শেষ করি। বাড়ির কাছেই বাঁশঝাড়ের পাশে পারিবারিক কবরস্থান। সেইখানে তিনি একবার যান। ২৯ রোজার বিকেলে। তার শ্বশুরের কবর, শাশুড়ির কবর। তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী স্বামীর কবর। তিনি কবরের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে পড়ে তার মুখে, তার সাদা চুলে। এবার ঈদ একা একা কাটাতে হবে তাকে!
ইফতারের আগে বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়ান তিনি। দূরে তেঁতুলগাছের নিচটা পর্যন্ত রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। ওই যে একটা রিকশাভ্যান আসছে। ওটা কোন বাড়িতে যাবে!
রাত বাড়ে। আজ রাতেও তিনি খাবেন না। তিনি শুয়ে পড়েন। হঠাত্ই মাঝরাতে শোনা যায় দরজায় কড়া নাড়া, ‘দাদি দাদি, আমরা এসেছি।’ এবার তিনি ধড়ফড় করে উঠে পড়লেন, সারা রাত চলবে তার ঈদের প্রস্তুতি। এবার তার ঈদ হয়ে উঠবে সত্যিকারের উত্সব।
আমাদের সবার জীবনে উত্সবগুলো অর্থপূর্ণ, আনন্দপূর্ণ হয়ে উঠুক।
ঈদ মোবারক। শারদীয় শুভেচ্ছা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক। সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.