মেহেদী হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস: আওয়ামী লীগের স্থগিতাদেশ স্থায়ী নয়, যেকোনো সময় প্রত্যাহার হতে পারে by কাউসার মুমিন
সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করা সরকারের সিদ্ধান্তকে জোর সমর্থন করেন এবং এই পদক্ষেপ গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে অথবা অতীতের দমন-পীড়নের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে বলে যে আন্তর্জাতিক সমালোচনা তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। সাংবাদিক মেহেদী হাসান এ বিষয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের উত্থাপিত উদ্বেগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. ইউনূস এর বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি দেন। অমর্ত্য সেন ইতিপূর্বে সতর্ক করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হাসিনার শাসনামলের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এটি ভুল সমালোচনা। আমরা দলটিকে নিষিদ্ধ করিনি। দলটি বৈধ রয়েছে। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে ইউনূস ব্যাখ্যা করেন, নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগকে আসন্ন নির্বাচনে সম্ভাব্য বিঘ্নকারী হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। তারা মনে করছে, আপাতত তাদেরকে (আওয়ামী লীগ) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে না দেয়াই ভালো। তবে স্থগিতাদেশ স্থায়ী নয়। যেকোনো সময় তা প্রত্যাহার করা যেতে পারে।
লাখ লাখ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কণ্ঠস্বর প্রকাশে সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে কিনা- মেহেদী হাসানের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস আওয়ামী লীগের দলীয় ভিত্তির স্কেলকে ছোট করে দেখান। তিনি বলেন, আমি বলব না লাখ লাখ। তাদের সমর্থক আছে, কিন্তু আমি জানি না কতজন বাকি আছে। অনেকেই প্রকৃত সমর্থক ছিলেন না বরং ক্ষমতার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন। ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বৈধ ভোটার হিসেবে থাকবেন, যারা আসন্ন নির্বাচনে অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে থেকে তাদের পছন্দের প্রার্থী বেছে নিতে পারবেন।
ইউনূস আরও অভিযোগ করে বলেন, গত বছর ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের ওপর সহিংস দমন-পীড়নের জন্য আওয়ামী লীগ দলটির কোনো অনুশোচনা নেই। যেখানে জাতিসংঘের পরিসংখ্যানে ওই সহিংসতায় আনুমানিক ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ এখনও দুঃখ প্রকাশ বা কোনো দায় স্বীকার করেনি। একটি শব্দও নয়। তিনি বলেন, এসব কারণে দলটির স্থগিতাদেশকে ন্যায্যতা দেয়া হয়েছে।
হিন্দুসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার খবরে প্রথমেই চাপের মুখে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার। গত নভেম্বরে হাজার হাজার হিন্দুর বিক্ষোভ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পসহ বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিত্বদের সমালোচনার জবাবে ইউনূস সেসব দাবিগুলোকে ভুয়া খবর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি ভারতকে ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করেছেন। সম্প্রদায়ের (হিন্দু-মুসলিম) মধ্যে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে। কখনও কখনও জমি বা পাড়ার দ্বন্দ্ব থাকে। কিন্তু পদ্ধতিগত হিন্দু-বিরোধী সহিংসতার ধারণাটি অতিরঞ্জিত বলে মন্তব্য করেন ইউনূস। সমালোচনা সত্ত্বেও জোর দিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশকে জর্জরিত করা কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক চক্রের পুনরাবৃত্তি রোধে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সাময়িক স্থগিতাদেশ প্রয়োজনীয়। ইউনূস মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্নগুলো কার্যত এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, এটি নোবেল কমিটির বিষয়। তারা সিদ্ধান্ত নিবে। জবাবে মেহেদি হাসান অট্টহেসে বলেন, উত্তরটি খুব ভালো হয়েছে, খুব ভালো কূটনৈতিক উত্তর।
পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রশ্নে ড. ইউনূস এ বছর বাংলাদেশের পাসপোর্টে ইসরাইল ছাড়া সকল দেশের জন্য বৈধ লাইন পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ভ্রমণ দলিলে থাকা এই বাক্যাংশটি ২০২১ সালে শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক বাদ দেয়া হয়। ইউনূস ব্যাখ্যা করেন, পুরো বাংলাদেশই সেই সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিল। আমরা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিইনি এবং আমরা এমন কোনো খোলামেলা পরিস্থিতি তৈরি করতে চাই না।
গাজায় চলমান সহিংসতাকে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, এটা বলতে নোবেল বিজয়ী হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন মানুষ হিসেবেই এটি বলা যায় যে এটা গণহত্যা। শিশুরা মারা যাচ্ছে, খবারের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছে মানুষ। পুরো বিশ্বের জন্য লজ্জার বিষয় যে আমরা আমাদের স্ক্রিনে এটি দেখি কিন্তু কিছুই করি না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করেননি। ২৭ বছর বয়সী তরুণ নেতা নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলটি গঠিত হলেও সরকার প্রধান হিসেবে নিরপেক্ষ থাকা জরুরি বলে মনে করেন ড. ইউনূস। সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে তিনি বলেন, যদি আমি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কিছু বলি তাহলে তা পক্ষপাতপূর্ণ মনে হবে। আমি শুধু আওয়ামী লীগ নিয়ে মন্তব্য করি কারণ তারা এখন দৃশ্যপটের বাইরে।
গত বছরের ছাত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়া এবং কিছু সময়ের জন্য ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের অংশ থাকা নাহিদ ইসলামের নতুন দলকে কিছু সমালোচক ইউনূসের প্রোটেজে হিসেবে দেখলেও মেহেদী হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটি সমালোচকদের অনুমান বলে উল্লেখ করেন ইউনূস। তিনি বলেন হ্যাঁ, তিনি সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন এবং ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন যারা আমাকে ডেকেছিল। তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে, কিন্তু আমি তাকে সমর্থন করিনি। তাদের দলকেই নিজেদের নীতি এবং ভবিষ্যৎ কৌশল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে হবে।

No comments