সেন্ট মার্টিন দ্বীপ: ‘২৮ বছরেও কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি, কীভাবে বেঁচে আছি জানতে চায়নি’ by আব্দুল কুদ্দুস
কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২ নম্বর শেডের একটি ঘরের সামনে বসে কথাগুলো বলছিলেন হাবিবুর রহমান। ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন সেন্ট মার্টিনের এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্বোধন হয়। দেশের প্রথম আশ্রয়ণ প্রকল্প ছিল এটি। সে সময় ঝড়ে ঘর হারানো হাবিবুর রহমানসহ ৫০টি পরিবারের স্থান হয়েছিল এই প্রকল্পে।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নের সাবেক দুই চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান ও ফিরোজ আহমদ খান বলেন, নির্মাণের পর দ্বীপের মধ্যভাগে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝের পাড়ায় গড়ে তোলা দেশের প্রথম এই আশ্রয়ণ প্রকল্প প্রতিষ্ঠার পর আর কেউ খোঁজখবর রাখেনি। সংস্কার হয়নি ঘরগুলোর। এখানকার বাসিন্দারা একরকম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
বেহাল আশ্রয়ণ প্রকল্প
দ্বীপের কয়েকজনের দান করা ৮০ শতক (দুই কানি) জমির ওপর টিনের ছাউনি ও বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মিত হয়েছিল আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাঁচটি লম্বা শেড। সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোর। স্থাপন করা হয়েছিল তিনটি নলকূপ ও তিনটি স্যানিটারি ল্যাট্রিন। নিরাপত্তার জন্য দেওয়া হয় কাঁটাতারের সীমানা বেড়াও।
ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছরে ঘরগুলোর কোনো সংস্কার হয়নি। টিনের ছাউনি ও বাঁশের বেড়া নষ্ট হয়ে গেছে। বাসিন্দাদের অবস্থাও নাজুক।
মুজিবুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের ৯ জুন কক্সবাজার জেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত জেলা ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন পর্যন্ত জেলার টেকনাফ, উখিয়া, সদর, চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, ঈদগাঁও, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলাতে দুই কক্ষবিশিষ্ট ৪ হাজার ৬৬৪টি পাকা ঘর হস্তান্তরের মাধ্যমে ১ হাজারের বেশি দরিদ্র পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু সেন্ট মার্টিনবাসীর কপালে জোটেনি একটিও ঘর। কারণ, ঘর তৈরির জন্য দ্বীপের কোথাও খাসজমি ছিল না। নানা অজুহাতে দেশের প্রথম আশ্রয়ণ প্রকল্পটি সংস্কারও করা হয়নি।
৬ সেপ্টেম্বর আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে ৮০টি পরিবারের ৪০০ জনের বেশি বাসিন্দা থাকছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোতে। লোক বাড়লেও বাড়েনি ঘরের সংখ্যা। জীর্ণ ঘরগুলোতে কোনোরকমে বসবাস করছেন বাসিন্দারা। নির্মাণের পর থেকে কোনো সংস্কার হয়নি বলে জানান আশ্রয়ণ প্রকল্পের লোকজন। দীর্ঘ ২৮ বছরে কেবল খাওয়ার পানি সরবরাহব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।
মাঝের পাড়ার বাসিন্দা ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আল নোমান প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ ঘর বহু আগেই ভেঙে পড়েছে। পলিথিনের বেড়া ও ছাউনির ঝুপড়িতে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছেন বাসিন্দারা। চারদিকঘেরা বেড়া নেই, নেই বিদ্যুৎ। ল্যাট্রিন নষ্ট হওয়ায় খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করতে হচ্ছে। নলকূপগুলো কয়েক বছর অচল ছিল। সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) পাইপলাইন টেনে বাসিন্দাদের খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আয়রোজগারের কোনো সুযোগ না থাকায় জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। সাগরে মাছ ধরা না পড়লে দুঃখ-কষ্ট বেড়ে যায়।
৫ নম্বর শেডের আরেকটি কক্ষে থাকেন জুলেখা বেগম। সঙ্গে তাঁর অসুস্থ স্বামী, ছেলে, ছেলের বউ-নাতিসহ ১০ জন। স্থানসংকুলান না হওয়ায় পলিথিনের বেড়া ও ছাউনি দিয়ে আরেকটি পৃথক কক্ষ তৈরি করতে হয়েছে।
জুলেখা বেগম (৫০) প্রথম আলোকে বলেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে যখন দ্বীপে পর্যটক আসে। তখন ছেলে ইজিবাইক (টমটম) চালিয়ে কিছু আয় করে। অন্য সময় বেকার থাকতে হয়।
কবে হবে নতুন ঘর
জনপ্রতিনিধিরা জানান, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান সেন্ট মার্টিন আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করেছিলেন। বাসিন্দাদের দুরবস্থা, দুঃখ-কষ্ট দেখে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘরগুলো সংস্কার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। তবে সেই প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়িত হয়নি।
ইউপি সদস্য আল নোমান বলেন, পুরোনো ঘরগুলো সরিয়ে সেখানে পাঁচটি নতুন শেড ঘর নির্মাণের জন্য এক দশক ধরে বিভিন্ন দপ্তরে লেখালেখি করা হচ্ছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মেয়াদ বা কাজ গত জুন মাসে শেষ হয়েছে। এখন নতুন করে দেশের কোথাও আশ্রয়ণ প্রকল্প হচ্ছে না। সেন্ট মার্টিন আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিষয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে সংস্কার করা হবে। আপাতত সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য খাদ্যসহায়তা পাঠানো হচ্ছে।
![]() |
| জীর্ণ হয়ে পড়েছে সেন্ট মার্টিনে দেশের প্রথম আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। কষ্টে দিন কাটে বাসিন্দাদের। ছবি: প্রথম আলো |

No comments