করবিনের নতুন দল বাম রাজনীতির শূন্যতা ঘোচাতে পারবে by জন রিস

আফ্রিকান হাতির গর্ভকাল প্রায় দুই বছর দীর্ঘ। কিন্তু যুক্তরাজ্যে একটি নতুন বামপন্থী দলের জন্মের জন্য যাঁরা অপেক্ষা করেছেন, তাঁদের অপেক্ষার তুলনায় সেটি যেন চোখের পলক ফেলার মতোই ক্ষণস্থায়ী। বহু মাস ধরে সাবেক লেবার নেতা জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে একটি দল অন্যদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে। বিভিন্ন পরিকল্পনা তারা প্রণয়ন করছে। কিন্তু ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারেনি।

এখন অবশেষে করবিন ও জারাহ সুলতানা একটি নতুন দল গঠনের ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এই ঘোষণার সঙ্গে কোনো কর্মসূচি, নীতি, নাম বা সাংগঠনিক কাঠামো ঘোষণা করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে কেবল সহনেতৃত্বের ঘোষণার ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোটাও সহজ কাজ ছিল না।

সৌভাগ্যক্রমে তৃণমূলের উদ্দীপনা এ মুহূর্তে এই দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দলের মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঐকমত্যের ঘাটতিকে এই উদ্দীপনা ঢেকেও দিচ্ছে এবং এই মুহূর্তে বামপন্থীরা যত ঝামেলাতেই পড়ুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের তাদের সাহায্য করা বন্ধ করছেন না! সম্প্রতি ভিন্নমতাবলম্বী চারজন লেবার এমপিকে সমাজকল্যাণ তহবিল কাটছাঁটের বিরুদ্ধে সফল বিদ্রোহের কারণে পার্লামেন্টারি দল থেকে বহিষ্কার করে স্টারমার বামপন্থীদের আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে একটি নতুন দলের প্রয়োজন কতটা জরুরি। ডায়ান অ্যাবটকে হুইপের পদ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া প্রমাণ করে যে স্টারমারের বামপন্থাবিরোধী ঘৃণা এতটাই গভীর যে তা তাঁর নিজের দলের জন্যও আত্মঘাতী হয়ে উঠছে।

জন্মপর্বটি বেশ জটিল হওয়া সত্ত্বেও নতুন এই বামপন্থী দল বিশ্বব্যাপী ব্যাপক উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই ছয় লাখের বেশি মানুষ সমর্থক হিসেবে নাম লিখিয়েছেন।

দলটির সামনে অবশ্যই রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক—দুই দিক থেকেই অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবেএকটি আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণ করা। কেননা, এই নীতিই কোটি কোটি ভোটারের কণ্ঠস্বরকে প্রতিধ্বনিত করবে। এটি তুলনামূলকভাবে সহজ চ্যালেঞ্জগুলোর একটি মনে হতে পারে। কারণ, গত নির্বাচনে চারজন স্বতন্ত্র এমপি এবং জেরেমি করবিন ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁরা সফল হয়েছিলেন। কারণ, জনসাধারণের মধ্যে ইতিমধ্যেই ব্যাপক ফিলিস্তিনপন্থী মনোভাব রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আর কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে কার্যত অনুপস্থিত।

কিন্তু এরপরও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল যে যুদ্ধ বিস্তার করছে, তাতে করে কেবল ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনের প্রশ্নটিই নয়, আরও ইস্যু সামনে নিয়ে আসছে। ইরানে ইসরায়েলের হামলার ব্যাপারে কী হবে? এ ঘটনা কি গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা? হুতিদের নিয়ে নতুন বামপন্থী দলের অবস্থান কী হবে? কিংবা যুক্তরাজ্যের আইনে নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুল্লাহর ব্যাপারে দলটির দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে?

এ প্রশ্নগুলোর সমাধান হয়তো তুলনামূলকভাবে সহজেই করা সম্ভব হবে। কারণ, ইসরায়েল যুদ্ধবাদী অবস্থান ও তৎপরতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজের অবস্থান এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যে দেশটির বিরোধিতা ক্রমেই আরও স্বাভাবিক ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অন্তত ভোটারদের এ অংশ নতুন একটি বামপন্থী দলকে ভোট দিতে আগ্রহী হবেন।

কিন্তু গাজার বাইরেও আরও কঠিন বিষয় রয়েছে, যেগুলো যুক্তরাজ্যের রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। ইউরোপজুড়ে এখন পুনরায় সামরিকীকরণ কর্মসূচি পুরোদমে চলছে। এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারযুদ্ধ এবং ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এটা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এটি স্টারমার সরকারের একটি কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক অবস্থান।

‘ন্যাশনাল এনডেভার’ নামে একটি বড় ‘দেশপ্রেমমূলক’ প্রচারাভিযান চলছে। স্টারমার বলেছেন, ‘যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি’ নিশ্চিত করতেই এ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা তো আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘আমরা’ আগামী ‘পাঁচ বছরের মধ্যে’ রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ব।

এই যুদ্ধ-তৎপরতার বিরোধিতা করা মানেই হচ্ছে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। একই সঙ্গে গণমাধ্যমের তোপের মুখে পড়া এবং যুক্তরাজ্যের লেবার, কনজারভেটিভ ও রিফর্ম—এই তিন দলের সম্মিলিত অবস্থানের বিপক্ষে দাঁড়ানো।

করবিন এর আগেও এই অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। খুব কম মানুষ ভুলে যেতে পারেন, লেবার পার্টির নেতা থাকাকালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় সরাসরি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তাঁকে কীভাবে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়েছিল।

করবিন এই চাপকে মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন, তার কারণ হলো তিনি জীবনব্যাপী যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিবাদী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।

কিন্তু সুলতানা এখনো সেভাবে এ ধরনের শান্তিবাদী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে পারেননি। সেটা জোরদার করা তাঁর জন্য উপকারী হবে। করবিনের উপদেষ্টাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক নেতায়ই শান্তিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।

বামপন্থী সামাজিক গণতন্ত্র, যেটি একসময় ডানঘেঁষা সমাজতন্ত্রে পরিণত হয়, এ রকম কোনো রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা কেবল হতাশা ও ব্যর্থতার জন্ম দিতে পারে। এটি কোনো আকর্ষণীয় বিকল্প নয়।

নতুন বামপন্থী দলকে শুরু থেকেই আরও মৌলিক পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষী ও দৃঢ়ভাবে সমাজতান্ত্রিক হতে হবে। পার্লামেন্টের বাইরের সংগ্রামকে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করাই দলটির মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত। বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট এতটাই গভীর যে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে সামান্যতম পরিবর্তন আনতেও সবচেয়ে র‍্যাডিকাল পদক্ষেপ প্রয়োজন।

* জন রিস, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো এবং স্টপ দ্য ওয়ার কোয়ালিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা
- মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

জেরেমি করবিন দীর্ঘদিন ধরেই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন করে আসছেন
জেরেমি করবিন দীর্ঘদিন ধরেই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন করে আসছেন। ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.