জাতিসংঘে পরিস্থিতিতে খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন নেতানিয়াহু! by মোহাম্মদ আবুল হোসেন
হারেৎজে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলি সেনারা তার ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করেছে গাজার ভেতরেও- লাউডস্পিকারে, এমনকি ফোন দখল করে। সেখানে হিব্রু ভাষায় সরাসরি বার্তা পাঠানো হয় আটক ব্যক্তিদের উদ্দেশে।
কিন্তু তার সবচেয়ে চমকপ্রদ পদক্ষেপ ছিল বুকের ওপর লাগানো একটি ব্যাজ, যাতে একটি বারকোড ছিল। প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, ৭ই অক্টোবরের আগে কেউই এই ব্যাজ পরেনি। যে কেউ কোডটি স্ক্যান করলে পৌঁছে যেত এক ওয়েবসাইটে, যেখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল ৭ই অক্টোবর নিহত ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিকদের ভয়াবহ ছবি। কার্যত তিনি নিজের শরীরকেই ভয়াবহতার প্রদর্শনীতে পরিণত করেন। যুক্তি হিসেবে বলেন, কেন আমরা লড়াই করি আর কেন জিততেই হবে- এটাই ব্যাখ্যা।
কিন্তু এই নিখুঁতভাবে সাজানো সব প্রদর্শনী শুরু থেকেই ব্যর্থতার মুখোমুখি। কারণ, নেতানিয়াহু ও তার ঘনিষ্ঠরা বুঝতেই চান না- ৭ই অক্টোবরের নৃশংসতা কখনোই বৈধতা দিতে পারে না গাজায় প্রতিদিন ঘটে চলা নৃশংসতার অবসানহীন ধারাকে।
গাজার যুদ্ধ জাতিসংঘের ভেতরে-বাইরে ভয়াবহ চিত্রের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। মাত্র দু’দিন আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগানও একই রকম কৌশল নেন। তিনি মঞ্চে গাজার ভয়ঙ্কর তিনটি ছবি তুলে ধরেন। নেতানিয়াহু ভালো করেই জানেন, তিনি মূলত নিজের ঘরোয়া সমর্থকদেরই উদ্দেশ্য করে কথা বলেছেন। তাই তার সামনে প্রায় খালি হল দেখে অবাক হওয়ার কথা নয়। বহু মুসলিম দেশ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এমনকি কিছু ইউরোপীয় দেশের প্রতিনিধিরাও তার বক্তব্য শুরু হতেই ওয়াকআউট করেন। এত মানুষ একসঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ায় হলের দরজায় সাময়িক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, সভাপতিকে কয়েক মিনিট শৃঙ্খলার আহ্বান জানাতে হয়। অন্যদিকে গ্যালারিতে উপস্থিত কয়েক ডজন সমর্থক চিৎকার, শিস আর করতালিতে ভরিয়ে তোলেন।
শুধু ইরান, কাতার, আলজেরিয়ার আসনই নয়- মধ্যপন্থী বলে পরিচিত কিরগিজস্তানের আসনও ফাঁকা ছিল। আয়ারল্যান্ড অধিবেশনের এই সেশনে যোগই দেয়নি। স্পেন মাঝপথে চলে গেছে। তবে বেশিরভাগ ইউরোপীয় প্রতিনিধি, আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মতো আব্রাহাম চুক্তির দেশগুলো আসনে রয়ে যায়। ইসরাইলের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক একঘরে হয়ে পড়ার তুলনায় এটাকে তুলনামূলক ভালো খবর ধরা হয়।
ভাষণে একাধিক জিভ ফসকানো ভুল করেন নেতানিয়াহু। কখনো ‘ইসরাইল’ বলতে গিয়ে বলেন ‘ইরান’। কখনো অস্ট্রেলিয়া বলতে গিয়ে বলেন অস্ট্রিয়া। তবে দ্রুতই নিজেকে ঠিক করেন। ভাষণটি মূলত দুই শ্রোতাদের উদ্দেশে ছিল। প্রথমত, ইসরাইলের ডানপন্থী ভোটব্যাঙ্ক, যাদের জন্য পরবর্তীতে গাজায় সম্প্রচারিত ক্লিপ নিয়ে নির্বাচনী ভিডিও বানানো হবে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র- বিশেষ করে হোয়াইট হাউসে থাকা ব্যক্তির উদ্দেশে।
তিনি মার্কিন জেনারেলদের উদ্ধৃতি দেন, ইসরাইল থেকে যুক্তরাষ্ট্র যে গোয়েন্দা সুবিধা পাচ্ছে তা জোর দিয়ে বলেন, আবারও দাবি করেন ইরান ও তার সহযোগীরা ‘আমেরিকার মৃত্যু’ স্লোগান তোলে। তিনি অভিযোগ করেন, ইরান নাকি দু’বার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে হত্যার চেষ্টা করেছে (যদিও বাস্তবে শুধু ট্রাম্পের ওপর একবারের চেষ্টা ইরানের সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়)। এছাড়া তিনি ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ক্ষতিকে আমেরিকান তুলনায় দাঁড় করান। বলেন, তারা যদি ৪০,০০০ আমেরিকানকে হত্যা করত, ১০,০০০ আমেরিকানকে জিম্মি করত।
তিনি ইউরোপীয় নেতাদেরও আক্রমণ করেন যারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। দাবি করেন, ইসরাইলিদের বিপুল অংশই তার সঙ্গে একমত। প্রতিশ্রুতি দেন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের শক্তির ভিত্তিতে শান্তি আসবে। বৈশ্বিক ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আর জোর দিয়ে বলেন, গাজায় গণহত্যা হচ্ছে না।
রেটোরিক্যাল প্রশ্ন ছুড়ে দেন, নাজিরা কি ইহুদিদের বলেছিল চলে যাও, দয়া করে চলে যাও? ইঙ্গিত করেন ইসরাইল নাজিদের মতো আচরণ করছে না। অথচ ইতিহাসবিদরা জানেন- নাজি শাসনের প্রথম দিকে ঠিক এটিই করা হয়েছিল, জার্মানি থেকে ইহুদিদের স্বেচ্ছা প্রবাসে উৎসাহিত করা হতো। এ ছাড়া তার পুরো বক্তৃতাই ছিল পুরনো বুলি, মাসের পর মাস ধরে শোনা কথা। গাজার যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিংবা কোনো সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে তিনি নতুন কিছুই বলেননি। ভাষণ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনও শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। জানানো হয়, সোমবার ওয়াশিংটন সফরের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন।
জাতিসংঘে আবারও প্রমাণ হলো- বিশ্বের উদ্দেশে নেতানিয়াহুর কোনো বার্তা নেই। কোনো সংলাপ নেই। তার সমস্ত আশা, ভয় আর প্রচেষ্টা নিবদ্ধ কেবল এক জায়গায়- হোয়াইট হাউসে, যার ওপর ইসরাইলের সরকার সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

No comments