ফিলিস্তিন নিয়ে ভারতকে চুপ থাকলে চলবে না by সোনিয়া গান্ধী
ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই জাতিসংঘে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য ইস্যু তুলেছিল এবং বর্ণবাদী শাসনের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। আলজেরিয়ার স্বাধীনতাসংগ্রামের (১৯৫৪-৬২) সময় ভারত ছিল স্বাধীন আলজেরিয়ার জোরালো সমর্থক। ফলে আন্তর্জাতিক মহল এই সংগ্রামকে ভুলে যেতে পারেনি। এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই।
১৯৭১ সালে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ঠেকাতে এবং আজকের বাংলাদেশের জন্ম ঘটাতে দৃঢ়ভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল। ভিয়েতনামে রক্তপাতের সময় যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ চুপ করে ছিল, তখন ভারত ছিল নৈতিকতার কণ্ঠস্বর। ভারত তখন শান্তির আহ্বান জানিয়েছিল এবং বিদেশি আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিল। আজও ভারত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অন্যতম বড় সেনা অবদান রাখছে। ভারতের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্দেশক নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা’ ভারতের একটি কর্তব্য।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভারত সব সময়ই সংবেদনশীল ও নীতিগত অবস্থান নিয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। ১৯৭৪ সালে ভারত প্রথম দিককার দেশগুলোর একটি ছিল, যারা পিএলওকে স্বীকৃতি দেয়। তখন থেকেই ভারত দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষ নিয়ে আসছে; যেখানে ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে, আবার ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানও সম্ভব হবে।
বছরের পর বছর ভারত জাতিসংঘের নানা প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং পশ্চিম তীর দখল ও বসতি স্থাপনকে নিন্দা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভারত ইসরায়েলের সঙ্গেও পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) প্ল্যাটফর্মে ভারত সব সময় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান, আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা এবং সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। ভারত ফিলিস্তিনকে মানবিক সহায়তাও দিয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সহায়তা, গাজা ও পশ্চিম তীরে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সাহায্য, শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতের বহু অবদান রয়েছে।
কিন্তু গত দুই বছরে, বিশেষ করে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরুর পর থেকে ভারত কার্যত তার আগের ভূমিকা থেকে সরে এসেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নৃশংস ও অমানবিক হামলায় ইসরায়েলি সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এরপর ইসরায়েল যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা একেবারে গণহত্যার পর্যায়ে চলে যায়।
এখন পর্যন্ত ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ১৭ হাজার শিশু। গাজার স্কুল, হাসপাতাল, বাসস্থান, কৃষি ও শিল্প সব ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষ দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিতে পড়েছে। ইসরায়েলি সেনারা খাদ্য ও ওষুধের ত্রাণ আটকে দিয়েছে। এমনকি মানুষ খাবার নিতে গেলে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই নৃশংস ঘটনা সেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্বও খুব ধীরে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ফলে অনেকটা পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। তবে সম্প্রতি কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি অনেক দেরিতে হলেও ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটি ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মানবাধিকারের নীতিকে আবারও সামনে আনা হচ্ছে। এটা শুধু কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক দায়িত্বের স্বীকৃতি।
আধুনিক বিশ্বে নীরব থাকা নিরপেক্ষতা নয়; বরং অন্যায়ের সহযোগিতা। আর এখানেই ভারতের কণ্ঠস্বর, যা একসময় স্বাধীনতা ও মানবমর্যাদার পক্ষে দৃঢ় ছিল। কিন্তু সেই স্বর এখন অনেকটাই নীরব হয়ে গেছে। মোদি সরকারের প্রতিক্রিয়া মূলত নীরবতা আর মানবিকতা ও নৈতিকতার অভাবে ভরা। ভারতের সংবিধানের মূল্যবোধ বা কৌশলগত স্বার্থের চেয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বই যেন তাদের অবস্থান ঠিক করছে।
কিন্তু এ ধরনের ব্যক্তিনির্ভর কূটনীতি টেকসই নয়। এটি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির দিশা হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য জায়গায় এমন প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়ে দেশকে অপমানজনক পরিস্থিতিতে ফেলেছে। ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থান কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত গৌরব অর্জনের প্রচেষ্টায় গুটিয়ে যেতে পারে না, কিংবা শুধু অতীত ইতিহাসের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে থাকতে পারে না।
এর জন্য দরকার ধারাবাহিক সাহস আর ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা। অবাক করার মতো বিষয় হলো মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। শুধু তা–ই নয়, বরং ইসরায়েলের বিতর্কিত সেই কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রীকেও ভারত আতিথ্য দিয়েছে, যিনি পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার উসকানির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত।
ফিলিস্তিন ইস্যুকে ভারত শুধু বৈদেশিক নীতি হিসেবে দেখলে চলবে না। এটি ভারতের নৈতিক ও সভ্যতাগত ঐতিহ্যেরও পরীক্ষা। ফিলিস্তিনের মানুষ বহু দশক ধরে বাস্তুচ্যুতি, দখল, বসতি সম্প্রসারণ, চলাফেরার বাধা, আর বারবার নাগরিক, রাজনৈতিক ও মানবাধিকারের ওপর আক্রমণ সহ্য করছে। তাদের এই দুর্দশা অনেকটা ভারতের ঔপনিবেশিক যুগের লড়াইয়ের মতো।
যখন আমাদের জনগণ সার্বভৌমত্ব হারিয়েছিল, দেশহীন ছিল, সম্পদ লুট হয়েছিল, আর সব অধিকার ও নিরাপত্তা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল; তখন আমরা যেভাবে লড়াই করেছিলাম, ফিলিস্তিনিরা একইভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাই ভারতের উচিত ফিলিস্তিনের প্রতি ইতিহাসের সহমর্মিতা দেখানো এবং সেই সহমর্মিতাকে নীতিগত পদক্ষেপে রূপ দেওয়া।
ভারতের অতীত অভিজ্ঞতা, নৈতিক কর্তৃত্ব আর মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলতে, অবস্থান নিতে এবং কাজ করতে শক্তি জোগায়। প্রত্যাশা হলো, ভারত যেন পক্ষপাতিত্ব না করে। এখানে ইসরায়েল আর ফিলিস্তিনের মধ্যে কাউকে বেছে নেওয়ার প্রশ্ন নেই। প্রত্যাশা হলো ভারত যেন নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব দেখায়। যে মূল্যবোধের ওপর ভারত দাঁড়িয়ে আছে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেশটির যে আদর্শ ছিল, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভারতকে ভূমিকা রাখতে হবে।
* সোনিয়া গান্ধী, ভারতের কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির চেয়ারপারসন
- দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
![]() |
| সোনিয়া গান্ধী। ফাইল ছবি |

No comments