দুদকে অচলাবস্থা, কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু
দুদক সূত্রে জানা গেছে, একাধিক কর্মকর্তার হাতে বেশ কয়েকটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও অভিযোগপত্র তৈরি রয়েছে। যেগুলো কমিশনের আইন অনুযায়ী চেয়ারম্যান এবং দুই কমিশনারের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক সভায় সিদ্ধান্ত ছাড়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া প্রতিদিন শতাধিক অভিযোগ আসে দুদকে। এসব অভিযোগও চেয়ারম্যান-কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত কমিশনের অনুমোদন ছাড়া অনুসন্ধান শুরু করা যায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, যে কাজগুলো কমিশনের ক্ষমতা ছাড়া করা যায় না সেগুলো বন্ধ আছে। নতুন করে মামলার অনুমোদন, চার্জশিট অনুমোদন, ক্রোক সম্পত্তি অ্যাটাচমেন্ট, বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার মতো বিষয়গুলো করা যাচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, দুদক আইন ও বিধিতে চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেগুলো ফাংশন করা সম্ভব না। তবে যেসব অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ আগেই অনুমোদন হয়েছে, সেগুলো চলমান রয়েছে। কমিশন না থাকায় নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না।
দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধান শেষ হয়ে মামলার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে একশর বেশি ফাইল স্থবির হয়ে আছে। এ ছাড়া চার্জশিট তৈরি আছে অন্তত অর্ধশতাধিক। অন্যদিকে যাচাই-বাছাই শেষে নতুন করে অনুসন্ধানের জন্য ফাইল রয়েছে ৪০টির বেশি।
দুদকের চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার বিদায় নিয়েছেন ১১ দিন হয়েছে। এরমধ্যে গতকাল কমিশন নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠন হয়েছে। তবে কার্যক্রম গতিশীল হতে কমিশন গঠন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে। এ বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, কমিশন গঠন না হওয়ায় সিদ্ধান্ত দেয়ার মতো কাজগুলো বন্ধ আছে। নিয়োগ হয়ে গেলে সেসব কাজও গতিশীল হবে।
সার্চ কমিটিতে যারা আছেন: দুদকের চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার নিয়োগে গঠিত সার্চ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. রেজাউল হক। এতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বাংলাদেশের মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নূরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম ও সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাছাই কমিটি, চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে, উপস্থিত সদস্যদের অন্যূন ৩ জনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কমিশনারের প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে ২ জন ব্যক্তির নামের তালিকা প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। অন্যূন ৪ জন সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির কোরাম গঠিত হওয়ার কথা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বাছাই কমিটির কার্য-সম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা দেবে।
২০ বছরে ছয় কমিশন
২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করে একই বছরের ২১শে নভেম্বর দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খান।
আইন হওয়ার তিন বছর পর ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা হয়। দেরিতে বিধি হওয়ার কারণে প্রথম তিন বছর প্রথম কমিশনের কার্যক্রম ছিল সীমিত। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ‘এক-এগারোর’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে ২০০৭ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করে সুলতান হোসেন খান নেতৃত্বাধীন কমিশন। এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় কমিশন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের এপ্রিলে হাসান মশহুদ চৌধুরী পদত্যাগ করেন। তখন পদত্যাগের কারণ হিসেবে সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছিলেন, কমিশনের কাজে গতি আনার জন্যই তার পদত্যাগ। তবে তার সঙ্গে নিয়োগ পাওয়া দুই কমিশনার হাবিবুর রহমান ও মনজুর মান্নান থেকে যান।
এরপর ২০০৯ সালের বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব গোলাম রহমান দুদকের তৃতীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। আর হাসান মশহুদ চৌধুরীর কমিশনের দুই কমিশনার হাবিবুর রহমান ও মনজুর মান্নানের মেয়াদ শেষ হলে ২০১১ সালে নতুন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক জেলা জজ মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) এবং দুদকের এক সময়ের মহাপরিচালক মো. বদিউজ্জামান। এরপর মেয়াদ শেষে গোলাম রহমান চলে গেলে ২০১৩ সালের জুনে চেয়ারম্যান হন বদিউজ্জামান। তিনি প্রথমে কমিশনার এবং পরে চেয়ারম্যান পদে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত দুদকের চতুর্থ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। বদিউজ্জামানের মেয়াদ শেষে ২০১৬ সালের মার্চে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব ইকবাল মাহমুদ। পঞ্চম এ কমিশনে তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন সাবেক সচিব মো. মোজাম্মেল হক খান।
ইকবাল মাহমুদ কমিশনের মেয়াদ শেষে ২০২১ সালের মার্চে ষষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান আরেক সাবেক সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন সাবেক জেলা জজ মো. জহুরুল হক।
এদিকে, ইকবাল মাহমুদের কমিশনের সঙ্গে নিয়োগ পাওয়া কমিশনার মোজাম্মেল হক খানের মেয়াদ পূর্ণ হলে গত বছরের জুলাইয়ে সে পদে স্থলাভিষিক্ত হন সাবেক সচিব মোছা. আছিয়া খাতুন।
যেভাবে নিয়োগ হবে সপ্তম কমিশন
দুর্নীতি দমন কমিশনের ৬ ধারায় কমিশনারদের নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ৫ বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন তারা। এ আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব বাছাই কমিটির সদস্য হবেন। তবে তাকে না পাওয়া গেলে বা অসম্মত হলে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব সদস্য হবেন।
আপিল বিভাগের বিচারপতি এ কমিটির সভাপতি হবেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বাছাই কমিটির কার্য সম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা করবে। কমিশনার নিয়োগে সুপারিশের উদ্দেশ্য বাছাই কমিটির সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে তিনজনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কমিশনারের প্রতিটি শূন্য পদের জন্য দুইজন ব্যক্তির নামের তালিকা প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে।
No comments