কানাইঘাটে এ কেমন নির্মমতা! by ওয়েছ খছরু ও মুফিজুর রহমান

ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু মানতাহা। সহপাঠীদের সঙ্গে খেলা করছিল বাড়ির উঠোনে। সেই মানতাহাকে ধরে নিয়ে গলায় রশি পেঁচিয়ে খুন করলো ঘাতকরা। খুনের পর লাশ পাশের খালে মাটিচাপা দেয়া হয়। পুলিশ যখন ঘাতকদের একজনকে ধরলো তখনই বাড়িতে থাকা অন্যরা লাশটি গোপনে পুকুরে ফেলে দিতে চেয়েছিল। দেখে ফেলেন স্থানীয়রা। উদ্ধার হলো শিশুটি। পৃথিবীর আলোছায়ায় বেড়ে ওঠার আগেই শিশুটিকে হত্যা করলো ঘাতকরা। এমন ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের কানাইঘাটের বীরদল গ্রামে। গতকাল রোববার ভোররাতে যখন ঘটনাটি জানাজানি হয় তখন ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা বীরদল গ্রামবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ভোরেই তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় ঘাতক মার্জিয়ার বসতঘর। দিয়েছে আগুন। মানতাহা খুনের ঘটনায় ক্ষোভ বিরাজ করছে এলাকায়। মানতাহার বয়স পাঁচ কিংবা ছয়। সবেমাত্র নার্সারিতে পড়ে। গত ৩রা নভেম্বর এলাকায় ওয়াজ মাহফিল ছিল। বিকালের দিকে পিতা শামীম আহমদ তাকে নিয়ে ওয়াজ মাহফিলে যান। সেখান থেকে মানতাহা পছন্দের খেলনা কিনে নিয়ে আসেন। আর খেলনা নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে নিজ বাড়ির উঠোনে খেলা করছিলেন। সন্ধ্যার একটু আগে হঠাৎ সে নিখোঁজ হয়ে যায়। ৭ দিন ধরে কোনো খোঁজ নেই মানতাহার। সবাই অস্থির তার জন্য। এক পর্যায়ে শনিবার রাতে কানাইঘাট থানা পুলিশ আটক করে মানতাহার পার্শ্ববর্তী ঘরের বাসিন্দা মার্জিয়া বেগমকে। মা আলিফজানকে নিয়ে শামীম আহমদের বাড়ির পাশেই বসবাস করতেন মার্জিয়া। রাতে তাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার আশঙ্কা করেন বাড়িতে থাকা মার্জিয়ার মা আলিফজান বেগম। রাত ৩টার পর তিনি ঘর থেকে বের হয়ে খালে পুঁতে রাখা মানতাহার লাশ তুলেন।

এ দৃশ্য দেখে ফেলেন পূর্ব থেকে ওত পেতে থাকা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহিদ। আলিফজান বেগম যখন শিশু মানতাহার মরদেহ নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন তখনই চিৎকার শুরু করেন তিনি। এরপর জাপটে ধরতে যান আলিফজানকে। এ সময় লাশ খালে ফেলে আলিফজান দৌড়াতে থাকেন। আব্দুল ওয়াহিদের চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে আসেন মানতাহার পরিবার ও আশপাশের লোকজন। তারা এসে আলিফজানকে আটক করেন। এ সময় তারা মানতাহার গলিত লাশ দেখতে পান। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন স্থানীয়রা। তারা রাতেই আলিফজানের বসতঘর ভাঙচুর করেন। এরপর দেন আগুনও। খবর পেয়ে কানাইঘাট থানা পুলিশ এসে আলিফজানকে আটক করে নিয়ে যায়। একই সঙ্গে শিশু মানতাহার মরদেহ উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন; মানতাহার গলায় রশি পেঁচানো ছিল। তাকে রশি দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল ওয়াহিদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তিনি গভীর রাতে মানতাহার পিতার সঙ্গে কথা বলে নিজ বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি দেখতে পান বারান্দায় বসে আছেন আলিফজান। এতে তার সন্দেহ হয়। এরপর তিনি লুকিয়ে আলিফজানের গতিবিধি লক্ষ্য করতে গিয়ে দেখেন সে খালে মাটি খুঁড়ে লাশ বের করছে। আর এ দৃশ্য দেখে চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন এসে আলিফজানকে আটক করেন। তিনি বলেন- আলিফজান খালে পুঁতে রাখা লাশ পুকুরে ফেলে দিতে ভোররাতের দিকে একাই এ কাজটি করছিল। যখন আমি চিৎকার শুরু করি তখন সে লাশ ফেলে দৌড়াতে থাকে। আলিফজান ও তার মেয়ে মিলে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ধারণা করেন তিনি। যখন তার মেয়ে মার্জিয়া আটক হয়েছে তখন সে লাশ গুম করতে এই পথ বেছে নিয়েছে। এদিকে লাশ উদ্ধারের পর থেকে মাতম চলছে এলাকায়। শামীম আহমদ ও তার স্ত্রী মেয়ের শোকে পাথর হয়ে গেছেন।

শামীম আহমদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ওরা এতটাই পিশাচ যে আমরা মেয়েকে খুঁজছি অথচ তারা ঘটনা ঘটিয়ে মুখ বন্ধ করে ছিল। তিনি নরপিশাচ মা ও মেয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। কেন এই ঘটনা ঘটিয়েছে সে ব্যাপারে তিনি কোনো ধারণা না দিতে পারলেও জানিয়েছেন; কয়েক মাস আগে মার্জিয়ার কাছে পড়ালেখা করতো মানতাহা। এই সুযোগে মানতাহাকে নিয়ে মার্জিয়া প্রায় সময় বাজারে সহ বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতো। এ নিয়ে আমরা আপত্তি জানিয়েছি। এখন আর পড়তে যায় না। ওই সময় মানতাহার কয়েকটি ড্রেস মার্জিয়া চুরি করেছিল। লাশ উদ্ধারের পর দুপুরে কানাইঘাট থানায় এ নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন সিলেটের এডিশনাল এসপি রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান- পুলিশ সক্রিয় হওয়ার পর মানতাহা গুম ও খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন করা হয়েছে। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানিয়েছে; অপহরণের দিন সন্ধ্যায় মানতাহার গলায় রশি পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর লাশ তারা খালে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল। ঘটনার খবর পেয়ে বিকালে কানাইঘাটে মানতাহার বাড়িতে যান সিলেটের পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন; এই ঘটনার পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার যাতে সুষ্ঠু বিচার হয় সে কারণে পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দেবে। এ সময় তিনি নিহত মানতাহার পিতা ও মাতাকে সান্ত্বনা দেন। সন্ধ্যায় কানাইঘাট জোনের সহকারী পুলিশ সুপার অলক কান্তি শর্মা জানিয়েছেন- বিকাল পর্যন্ত আটক হওয়া চার জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের নিয়ে পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফসর আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন- মানতাহা গুম ও খুনের ঘটনায় এলাকার মানুষ আতঙ্কে আছেন। এমন ঘটনা তার এলাকায় অতীতে হয়নি। এ ঘটনার সঙ্গে নেপথ্যে যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করেন তিনি।  

mzamin

No comments

Powered by Blogger.