সংস্কারে পুলিশ বিভাগে কী পরিবর্তন আসবে? by বদরুল হুদা সোহেল

পুলিশ কমিশন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাস্তবতার নিরিখে পুলিশ কমিশন আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই কমিশন পুলিশকে জনগণের সেবক হিসেবে গড়ে তুলতে যা যা দরকার সবই করবে। পুলিশ সদস্যের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণসহ পুলিশের কৃতকর্মের জবাবদিহিতা এবং অভিযোগ উত্থাপিত হলে দুদক বা অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় স্বচ্ছতার মাধ্যমে তদন্তপূর্বক দোষীদের জন্য শাস্তির বিধান রাখবে এই কমিশন। তবে কর্মপরিধি বিবেচনায় মন্ত্রণালয় ও কমিশনের মধ্যে কোনো সাংঘর্ষিক আইন বা জটিলতা যেন সৃষ্টি না হয় এর জন্য পুলিশ কমিশন আইনের ক্ষমতা, কার্যাবলী ও আওতাধীন বিষয় নিয়ে স্পষ্টতা থাকতে হবে...

নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্ব-এ চারটি উপাদান মিলেই রাষ্ট্র। এর মধ্যে সার্বভৌমত্বকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটিকে রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা বলেও ধরা হয়, কারণ এ ক্ষমতার বলেই রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর আইনি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং বাহ্যিক শক্তির আক্রমণ বা হস্তক্ষেপ থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে পারে। আর আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে গেলেই সবার আগে পুলিশ বাহিনীর কথা চলে আসে। এই পুলিশ বাহিনী নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের কথাই আগে উল্লেখ করতে হয়। কারণ আজকের এই পুলিশ বাহিনীই মূলত পাকিস্তানি সৈন্যের বিরুদ্ধে রাজারবাগে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাহলে আজ এই পুলিশ বিভাগ সংস্কারে কমিশন গঠনের প্রয়োজন হলো কেন? স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠনের কথা আসছে কেন? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আগে এ প্রশ্নগুলো কেন উত্থাপিত হচ্ছে তা নিয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পুলিশ দেশের অন্যতম প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেই একজন মহাপরিচালক সর্বময় কর্তা হিসেবে পুলিশ বাহিনীকে পরিচালনা করে আসছেন। যত নিয়মকানুন আর বিধির কথাই বলা হোক না কেন, মূলত বাংলাদেশ পুলিশের অনেক কিছুই পরিচালিত হয় ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের নির্যাসে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য একটি যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ পুলিশ আইন এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। বাংলাদেশ নামক দেশটির সীমারেখা  যে সময়ে বিশ্বমানচিত্রে অঙ্কিত হয়নি তখন বৃটিশদের করা আইনটি আমরা নিজেদের মতো করে যেভাবে যতটুকুই গ্রহণ করি না কেন তা আধুনিক বাংলাদেশের পুলিশ ব্যবস্থাপনার জন্য কতোটুকু সঙ্গতিপূর্ণ? উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের মাধ্যমে তাদের করায়ত্ত বজায় রাখার স্বার্থে ছিল এই আইন। তাই কোনো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশের পুলিশ আইন আর ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থ রক্ষার আইন এক হতে পারে না। এই অর্থে পুলিশ আইন নিয়ে আরও আগেই ভাবার দরকার ছিল।

‘পুলিশ জনগণের সেবক’ বা ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ এ ধরনের উক্তি আমরা হরহামেশাই শুনে আসছি। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে জনগণ পুলিশের বা পুলিশ জনগণের কতোটুক কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে? অনেক সময় এমন হয় যে, আমাদের গণ্ড গ্রামের সাধারণ একজন মানুষ যখন প্রয়োজনে কোনো মামলা অথবা কোনো অভিযোগ দায়েরের উদ্দেশ্যে থানায় যেতে চায় তখন তিনি সেখানে একা যেতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন না। থানাওয়ালারা অনেক সময় ব্যক্তির জটিল কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে চান না-এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অগত্যা অভিযোগকারীরা পুলিশের মনোযোগ টানার জন্য কখনো কখনো স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি বা রাজনৈতিক প্রতাপশালী ব্যক্তির সহযোগিতা নেয়ার চেষ্টা করেন এবং ফলশ্রুতিতে সাধারণ কোনো মামলাতেও রাজনীতির প্রভাব চলে আসে। এমন ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ-অভিযোগকারী একে অপরকে দুষলেও বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে উভয়ের জন্য স্ববিরোধী মনে হলেও সত্য বিবর্জিত নয়।

যা শুরুতে বলতে চেয়েছিলাম, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যেকোনো সংকটে দেশের বহু পুলিশ অতীতে জীবন দিয়েছেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে যেকোনো বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিকভাবে এই বিভাগটিকেই কিন্তু জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের মতো যাবতীয় কাজ করতে হয়। করোনাকালীন সংকট মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনার হিসেবে এ দেশের পুলিশ বাহিনীই জীবন ঝুঁকি নিয়েছেন। তাহলে পুলিশকে কেন বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সরকারের রোষানলে পড়তে হচ্ছে? পুলিশকে ব্যবহার করে সরকার কেন ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করবে? যে পুলিশ দেশের নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মন্ত্রে তৈরি সেই পুলিশ জনগণের ওপর দমন-পীড়ন নীতি অনুসরণ করবে-এমনটা কাম্য নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রে কর্তৃত্ববাদ, একচ্ছত্রবাদ বা একদলীয় শাসন কায়েম আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কখনো এক হতে পারে না। গণতন্ত্রকে বাক্সবন্দি রেখে সরকার বা অন্য কেউ যদি ভিন্ন মনোভাব কায়েম করতে চায় তাহলে সে রাষ্ট্র পুলিশি রাষ্ট্রের ফর্মুলায় আটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।  সেখানে না থাকে স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা, না থাকে বাকস্বাধীনতা। তাই পুলিশ বাহিনীকে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করার জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। পুলিশকে সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব করতে চাইলে পুলিশ সদস্যের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, পদাবনতি (পুরস্কার ও শাস্তি) ইত্যাদি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বিদ্যমান আইনে পরিবর্তন আনতে হবে এবং এই সকল কর্মযজ্ঞ পুলিশ কমিশন দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।

কমিশনের গঠন ও ক্ষমতা এমন হতে হবে যেন কোনো সরকার পুলিশ কমিশনের উপর হস্তক্ষেপ করে পুলিশের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যকে ভিন্নখাতে পরিচালিত করতে না পারে। কারণ আমাদের দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থের নিমিত্তে পুলিশকে ব্যবহার করার অভিযোগ কম নয়। সততা, দক্ষতা ও নৈতিকতার আলোকে কমিশন গঠিত হলে পুলিশে একদিকে দূর হবে স্বেচ্ছাচারিতা ও অন্যদিকে বজায় থাকবে পেশাদারিত্ব।

পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এড়ানোর জন্য পুলিশ কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে কমিশনের সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। কমিশন যত সদস্য নিয়েই হোক, এতে কাদের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন তার একটু ইঙ্গিত দিতে চাই। যেহেতু বিষয়টি পুলিশ সম্পর্কিত, সেহেতু পুলিশের অংশীজন একজন সাবেক আইজিপি বা অতিরিক্ত আইজিপি, মানবাধিকার কমিশনের যেকোনো সাবেক চেয়ারম্যান, সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান বা সাবেক পরিচালক, কোনো অপরাধবিজ্ঞানী, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারক বা সাবেক জেলা জজ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সিনিয়র সাংবাদিক ও অন্তত দুজন নারী সদস্য মিলে এ কমিশন হতে পারে। প্রত্যেক সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের অতীত কর্মকালীন সার্ভিসের ট্র্যাক রেকর্ড ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। সরকার ইচ্ছা করলে বিতর্কিত যে কাউকে কমিশনে স্থান দিতে পারবে-এমন কোনো ফাঁকফোকর কমিশন আইনে রাখা যাবে না। প্রয়োজনে কমিশনের রূপরেখা কেমন হবে- এ মর্মে পুলিশ বিভাগ থেকে লিখিত আকারে পরামর্শ চাওয়া যেতে পারে। কমিশন সরকারের কোনো বিভাগ বা দপ্তরের হস্তক্ষেপে যেন কাজ না করে সেজন্য কমিশন কারও কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ হবে না। প্রশিক্ষণের আলোকে পুলিশকে পেশাদারিত্বের আওতায় এনে এ কমিশন একজন পুলিশ সদস্যের দায়িত্ব-কর্তব্য ও কর্মপরিধি ঠিক করবে।

গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ঠিক পর কিছুদিন পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতোটা অবনতি হয়েছিল তা আমরা উপলব্ধি করেছি। তাই এটা নিশ্চিত যে, পুলিশ বাহিনীর সক্রিয়তা-নিষ্ক্রিয়তার উপর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে কোনো রাজনৈতিক সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তার জন্য পুলিশ ব্যবহৃত হতে পারে না। বরং দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের শান্তি ও সুরক্ষার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকা পুলিশের জন্য অতীব জরুরি। আর একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশনই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে।
পুলিশ কমিশন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাস্তবতার নিরিখে পুলিশ কমিশন আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই কমিশন পুলিশকে জনগণের সেবক হিসেবে গড়ে তুলতে যা যা দরকার সবই করবে। পুলিশ সদস্যের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণসহ পুলিশের কৃতকর্মের জবাবদিহিতা এবং অভিযোগ উত্থাপিত হলে দুদক বা অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় স্বচ্ছতার মাধ্যমে তদন্তপূর্বক দোষীদের জন্য শাস্তির বিধান রাখবে এই কমিশন। তবে কর্মপরিধি বিবেচনায় মন্ত্রণালয় ও কমিশনের মধ্যে কোনো সাংঘর্ষিক আইন বা জটিলতা যেন সৃষ্টি না হয় এর জন্য পুলিশ কমিশন আইনের ক্ষমতা, কার্যাবলী ও আওতাধীন বিষয় নিয়ে স্পষ্টতা থাকতে হবে। পুলিশের মানোন্নয়নের জন্য শুধু নীতি প্রণয়ন নয়, আধুনিকায়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে পুলিশের কোনো সদস্য যেন বৈষম্যের শিকার না হয় সেদিকে পুলিশ কমিশন খেয়াল রাখবে। কারণ বৈষম্য থেকে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ, আর ক্ষোভ হলো ছাই চাপা আগুন যাকে বাইরে থেকে বুঝা না গেলেও এর উপর কিছু পড়লে দপ করে জ্বলে উঠা অসম্ভব কিছু নয়। দায়িত্ব পালনে পুলিশকে দিতে হবে স্বাধীনতা। পুলিশকে ভাবতে হবে তারা কারও হাতের পুতুল নয় যে কেউ তাদেরকে নিয়ে খেলবে।

অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাবেক সচিব সফররাজ হোসেনকে প্রধান করে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত  প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে সময় পাচ্ছে এই কমিশন। সংস্কারের মাধ্যমে ভবিষ্যতে পুলিশ বিভাগ কী পাবে তা সময়ই বলে দিবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কিশোরগঞ্জ।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.