অধ্যাদেশ দিয়ে চলবে সংসদ সচিবালয় by কাজী সোহাগ

সংসদ সচিবালয় আইনের পরিবর্তে এখন থেকে অধ্যাদেশ দিয়ে চলবে সংসদ সচিবালয়। ফলে আর্থিক ও প্রশাসনিক সব ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে সংসদ সচিবকে। আগের আইন অনুযায়ী সংসদ সচিবের দায়িত্ব ছিল প্রশাসনিক এবং নীতিগত বিষয়ে স্পিকারকে পরামর্শ দেয়া। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পদত্যাগের প্রেক্ষিতে আইনি জটিলতায় পড়ে ১২শ’ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংসদ সচিবালয়। ৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়িত্ব পাওয়া সংসদ সচিবকে সরিয়ে নতুন সচিব নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু স্পিকারের পদ খালি থাকায় বিদ্যমান আইনে সচিব কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। অনেক কিছু সংস্কারের বিষয় থাকলেও আর্থিক ক্ষমতা না থাকায় উদ্যোগ নিতে পারছেন না। সংসদ সচিবালয় আইন-১৯৯৪ অনুযায়ী স্পিকার সব ক্ষমতার অধিকারি। কোনো কারণে স্পিকারের পদ শূন্য হলে ডেপুটি স্পিকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংসদে ডেপুটি স্পিকারও নেই। তিনি বর্তমানে হত্যা মামলায় কারাগারে আটক আছেন। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে সংসদ সচিবের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে সংসদ সচিবের দায়িত্বে আছেন ড. মো. আনোয়ার উল্যাহ। গত ১৫ই সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা আদেশে, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিবকে সচিব হিসেবে পদোন্নতি প্রদান করে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে পদায়ন করা হয়। ১৭ই সেপ্টেম্বর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। তিনি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও মাঠ প্রশাসনের উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পদে তিনি কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ (বাজেট অনুবিভাগ), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে তার কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সচিবের ক্ষমতা বাড়ানো প্রসঙ্গে সংসদ সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের কাছে এ নিয়ে একটি অধ্যাদেশ-এর খসড়া পাঠানো হয়েছে। পরে এটা আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে পাঠানো হবে।  সম্ভবত এ সপ্তাহে জারি হবে। এটা হলে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সচিব পাবেন। বর্তমানে সংসদ সচিবালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু কম্পিউটার থেকে শুরু করে সরঞ্জামাদি কিনতে হবে। সচিবের এখন যে ক্ষমতা রয়েছে সেই ক্ষমতা বলে তা করা সম্ভব নয়। প্রয়োজনের তাগিদেই আসলে বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের কর্ম-বণ্টন আদেশ-২০১২ অনুযায়ী সচিবের ১৫টি ক্ষমতা রয়েছে। এর বেশির ভাগই রুটিন ওয়ার্ক ও স্পিকারকে পরামর্শ দেয়া। অধ্যাদেশ জারি হলে সচিবের ক্ষমতা এর থেকে বাড়বে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের ২৭ দিনের মাথায় জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করায় আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয়। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি, পদ সৃজন, বিলুপ্তিসহ বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন ও অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদের জন্য চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩৪৭ কোটি ১৩ লাখ টাকার বাজেট অনুমোদন করে সংসদ সচিবালয় কমিশন। পাশাপাশি আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩৮২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, ২০২৬-২৭ অর্থবছরের জন্য ৪২০ কোটি ৯৭ টাকার বাজেট প্রক্ষেপণ অনুমোদন করা হয়। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটের বেশিরভাগ টাকা এখন ব্যয় করতে পারছে না সংসদ সচিবালয়। অধ্যাদেশের বলে বাজেটের টাকা দিয়ে লুট হওয়া মালামাল কেনা ও সংসদ ভবনের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

খসড়া অধ্যাদেশে যা বলা হয়েছে
সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে- যেহেতু সংসদ ভেঙে গেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে মনে হয়েছে, আশু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান আছে। তাই সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ সচিবালয় (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ প্রণয়ন ও জারি করলেন। এতে জাতীয় সংসদ সচিবালয় আইন-১৯৯৪-এর (১৯৯৪ সালের ৮ নম্বর আইন) ধারা ২১-এর পর নতুন ধারা ২২ সংযোজিত হবে। ‘ক্রান্তিকালীন বিশেষ বিধান’ নামে নতুন ধারায় বলা হয়েছে: (১) এই আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন, জাতীয় সংসদ ভঙ্গ থাকলে এবং ভঙ্গকালীন সময়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার সংবিধানের ৭৪(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করলে এবং রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলে ও সংসদ সচিবালয় কমিশন বিদ্যমান বা বলবৎ না থাকলে, জাতীয় সংসদে স্পিকার নির্বাচন ও কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত জাতীয় সংসদ সচিবালয় আইন এবং এর অধীন প্রণীত বিধিমালা ও নীতিমালাসমূহে সব ধরনের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা (সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নিয়োগ, নিয়োগ বিধি সংশোধন, পদোন্নতি, পদ সৃজন ও বিলুপ্তি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা নির্ধারণ ও তাহাদের হ্রাস-বৃদ্ধি, সচিবালয়ের বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন ও বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়সহ অন্য সব বিষয়) সংসদ সচিবের ওপর ন্যস্ত হবে। এ ছাড়া (২) উপধারা (১)-এ উল্লিখিত (ক) পদ সৃজন ও বিলুপ্তি, (খ) কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা নির্ধারণ, (গ) কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধিকরণ, (ঘ) যুগ্ম সচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতি এবং (ঙ) নিয়োগ বিধি সংশোধন সংসদ সচিবের সভাপতিত্বে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং অর্থ বিভাগের সচিবের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পন্ন হবে। এদিকে আইনে অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে অধ্যাদেশ হলো এমন আইন যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি দ্বারা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুপারিশে জারি করা হয়, যা সংসদের আইনের মতোই ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সংসদের অধিবেশন না থাকলেই কেবল অধাদেশ জারি করা যেতে পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদ ভেঙে গেলে অথবা সংসদ অধিবেশন না থাকলে কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে এমন কোনো বিধান করা যাবে না যা বাংলাদেশ সংবিধানের অধীন সংসদের আইন দ্বারা আইন সঙ্গতভাবে করা যায় না কিংবা এর মাধ্যমে সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তিত হয়। কোনো অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর অনুষ্ঠিত সংসদের প্রথম বৈঠকে এটি উপস্থাপিত হবে এবং ৩০ দিনের মধ্যে সংসদ কর্তৃক পাস হলে আইনে পরিণত হবে অন্যথায় অধ্যাদেশের কার্যকারিতা বিলুপ্ত হবে।

No comments

Powered by Blogger.