বিহারি ক্যাম্পে অস্থিরতা, ৪ খুন by সুদীপ অধিকারী

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। গত ৫ই আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হঠাৎ করে অস্থির হয়ে উঠেছে এই বিহারি পল্লী। দু’গ্রুপের অস্ত্রের মহড়ায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪ জন। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ছোড়া গুলিতে আহত হয়েছেন আর অন্তত শতাধিক ব্যক্তি। আর এই সব কিছুই ঘটছে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে চলা মাদকের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।

সরজমিন জানা গেছে, ১৯৭১ সালে বাস্তুহারা বিহারিরা যারা মোহাম্মদপুরের রাস্তা, মসজিদ, স্কুলে অবস্থানরত ছিল তাদের জন্য ’৭২ সালে লিয়াকত হাউজিং সোসাইটির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে অস্থায়ী ভিত্তিতে মোহাম্মদপুর কলেজগেটের অদূরে গজনবী রোড ও বাবর রোডের মাঝের ১৭ একর জায়গা নিয়ে ক্যাম্প তৈরি করা হয়। সেখানেই বছরের পর বছর ধরে বসবাস করে আসছেন এই বিহারিরা। বর্তমানে নয়টি ব্লকে ভাগ হওয়া এই ক্যাম্পে প্রায় ৩৫ হাজার উর্দুভাষী লোকের বসবাস। ছোট্ট ছোট্ট খুপড়ি ঘরে ১৫-২০ জন করে থাকেন। দিনে-রাতে পালা করে ঘুমাতে হয় তাদের। মূলত রাজধানীর বিভিন্ন সেলুনে নরসুন্দরের কাজই তাদের প্রধান পেশা। তবে এই সরু গলির ঘরগুলোকে অনেকেই আবার মাদকের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে। বছরের পর বছর হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের কারবার চলছে এই ক্যাম্পের  ভেতর। আর এই সিন্ডিকেট এতটাই বেপরোয়া- তাদের ভয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনও ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকতে অনেক সময় সাহস করে না। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই মাদকের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতেই ৫ তারিখের পর থেকে মরিয়া হয়ে উঠে ভূঁইয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, আরমান, পলু কসাই, সৈয়দপুরিয়া, ছটু মাসুদ, মনু, চারকু, রাজ সহ একাধিক গ্রুপ। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল। তার হয়ে কাজ করেন তার ভাই টুনটুন, রানা, রাজন ওরফে কালু, কলিম জাম্বু, মোহাম্মদ আলী, আহম্মদ আলী ও বানর আরিফ। আর চুয়া সেলিমের পক্ষে রয়েছেন আরমান, আকরাম, মোল্লা আরশাদ, পেলু, কোপ মনু, পিস্তল নাঈম, শাহজাদা গেইল হীরা, সালাম, শান্ত, পিচ্চি রাজা, ফাট্টা আবিদ। সৈয়দপুরিয়া গ্রুপে আছেন তিল্লি শাহিদ, কামাল বিরিয়ানি, ইরফান বিরিয়ানি, মোল্লা জাহিদ, সাজ্জাদ, আমজাদ আলী বাবু। ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, সৈয়দপুরিয়া গ্রুপের বাবু ওরফে আমজাদ আলী বাবু, আসলাম ওরফে মেন্টাল আসলাম ও শেখ গোলাম জিলানি মূলত পারিবারিকভাবে ইয়াবা ও হেরোইনের কারবারে জড়িত। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে বিগত বছরগুলোতে ক্যাম্পে শক্ত অবস্থান ছিল সোহেলের। আর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিরোধীদের সাপোর্টে রাজত্ব করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন চুয়া সেলিম চক্র। আগে এসব দ্বন্দ্বে লাঠি, চাকু, দাউ, বঁটি, ছুরি ব্যবহার হলেও এখন যোগ হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। আর এই আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতেই নিহত হয়েছেন সনু, শাহেনশাহ্‌, সাগর ও শাহনেওয়াজ কাল্লু।
গত ১৬ই অক্টোবর এই মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে নিহত হন ক্যাম্পের ৮ নম্বর ব্লকের প্রয়াত আবু বক্কর সিদ্দিকের ছেলে শাহনেওয়াজ কাল্লু (৩৮)। তার বোন নাসরিন আখতার জানান, আমার ভাই স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। সেদিন রাতে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে ক্যাম্পের জালাল ডেকোরেটরের সামনে দুই গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে পড়েন। ওই সময় আমার ভাইয়ের গায়ে গুলি লাগে। পরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ভাইয়ের কথা বলতে বলতে অশ্রুশিক্ত হয়ে বলেন, আমার ভাইয়ের নামে কেউ কখনো কোনো অভিযোগ দিতে পারবে না। আমার ভাই কাজ করে খায়। আর তাকে এইভাবে গুলি করে মারা হলো। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। এর আগে গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন ক্যাম্পের বাবুল হোসেনের ছেলে অটোরিকশাচালক সানু। মাদক ব্যবসা নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে একপর্যায়ে সনুকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় প্রতিপক্ষ। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় সকাল সোয়া ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া তার প্রতিবেশী শামীম হোসেন ও সাজিদ আহমেদ বলেন, সনু জেনেভা ক্যাম্পের ৫ নম্বর সেক্টরে থাকতেন। সেদিন সকালে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেলকে সনু ভাই বলেছিলেন, ‘তুমি মাদক বিক্রি করছো, এতে এখানকার ছেলেরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’ পরে বিষয়টি নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। একপর্যায়ে সোহেলসহ কয়েকজন গুলি চালালে সনুর বুকে-পেটে গুলি লাগে। সে সময় বেল্লাল, শাহ আলম, শুভ, জানে আলম, শাওন নামে আরও বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। একইদিনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন শাহেন শাহ নামের আরও একজন। মাদক নিয়ে দ্বন্দ্বে ক্যাম্পের মো. ইসমাইল হোসেনের ছেলে মো. সাগর নামে আরও একজন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। মো. সাগরের প্রতিবেশী মো. শহিদ কুরেশি বলেন, এই সেদিনের কথা। সাগর ক্যাম্পের মধ্যে ওদের বাথানে (গরু রাখার জায়গা) গরু আনতে গিয়েছিল। এরমধ্যেই চুয়া সেলিম ও ভূঁইয়া সেলিম গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। তাদের ছোড়া গুলি এসে লাগে সাগরের মাথায়। সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তিনি বলেন, আগে লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষ হতো। গত ৫ই আগস্ট থানা থেকে এরা সব অস্ত্র লুট করেছে। সেই অস্ত্রই এখানে ব্যবহার হচ্ছে। আর এই অবৈধ অস্ত্রের গুলিতেই এত প্রাণহানি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো অভিযান হলেও তেমন কেউ ধরা পড়ে না। অস্ত্রও উদ্ধার হয় না।

এসব বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হাসান বলেন, জেনেভা ক্যাম্পের দ্বন্দ্ব মূলত মাদক বেচাকেনা নিয়ে। আমরা এসব সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু আমাদের লোকবল কম হওয়ায় তেমন ফলাফল পাচ্ছি না। তিনি বলেন, এরা অনেক আধুনিক। তারা ওয়াইফাই ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। মোবাইল ফোনে সিম থাকে না। আবার ক্যাম্প গিঞ্জি এলাকা হওয়ায় কোথায় মাদক ও অস্ত্র রেখে দেয় তাও পাওয়া যায় না। আর তাদের লোক ক্যাম্পের চারপাশে ছড়ানো থাকে। আমরা ঢোকার আগেই তারা খবর পেয়ে পালিয়ে যায়। এরপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে, কয়েকজনকে আমরা গ্রেপ্তারও করেছি। তিনি বলেন, আসলে মাদক নির্মূল করা পুলিশের একার কাজ না। এজন্য সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
mzamin

No comments

Powered by Blogger.