আন্দোলনের প্রভাবে শিশুদের আচরণিক পরিবর্তন

সাম্প্রতিক আন্দোলনের ফলে প্রাথমিক স্তরের শিশুদের মধ্যে নানা প্রভাব পড়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে আচরণিক। শিশুদের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক, দুঃখবোধ, অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, অশান্তি, চমকে ওঠা/বাকরুদ্ধ হওয়া, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অসহায়ত্ববোধ, অপরাধবোধ, ক্লান্তিবোধ, রাগ এসব প্রকাশ পাচ্ছে।

এসবের কারণে শিশুদের মধ্যে কিছু দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রেও নানা পরিবর্তন এসেছে। এরমধ্যে- ঘুমের সমস্যা ও দুঃস্বপ্ন হওয়া, স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা, পড়ালেখায় অনীহা, ভয়-ভীতিতে থাকা, বিষণ্নতা-হতাশাগ্রস্ত থাকা, মোবাইল ফোনে আসক্তি, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, উচ্ছৃঙ্খলতা-সহিংস আচরণ করা, কারিকুলাম পরিবর্তনে ভীতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি-খবর দেখে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়া, শিশুসুলভ চঞ্চলতা নষ্ট হওয়া, একাকিত্ববোধ, বন্যার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া, বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি বেড়ে যাওয়া।

গতকাল ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। গণসাক্ষরতা অভিযান ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (ব্র্যাক-আইইডি)-এর যৌথ আয়োজনে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে মতবিনিময় সভায় শিশুদের আচরণিক পরিবর্তনের নানা কারণ তুলে ধরা হয়। যেমন, সরাসরি ঘটনাস্থলে সহিংসতা দেখা বা ভীতিকর অভিজ্ঞতা হওয়া, করাও কাছ থেকে জানা, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখা, পত্রিকায় পড়া এবং তা কল্পনা করা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, গুরুতর অসুস্থতা বা আঘাত ও অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু।

শিশুদের মনে দীর্ঘ সময়ের প্রভাব হতে পারে সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারি, রাজপথে যারা গুলি ছোড়া দেখেছে ও পরিবারে বা আশেপাশে শিক্ষার্থীদের গুরুতর আহত হওয়া বা মৃত্যু দেখেছে।
এতে অভিভাবকদের জন্য নানা ভূমিকা পালনের কথা বলা হয়। এরমধ্যে অন্যতম- শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ, পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়া, পর্যাপ্ত খেলাধুলার উপাদান সরবরাহ করা, অন্যান্য শিশু বা বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দেয়া, মোবাইল থেকে দূরে রাখা বিশেষ করে মারামারি ও হিংস্রতা বিষয়ক গেম, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেয়া ও স্থানীয়ভাবে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।

বিদ্যালয় যেসব উদ্যোগ নিতে পারে- কো-কারিকুলাম ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা, খেলার মাঠ ও সরঞ্জাম দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ ক্লাব, ডিবেট ক্লাব ও স্বাস্থ্যসেবা ক্লাবের মতো প্ল্যাটফরম তৈরি করা, নিয়মিত শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা, শ্রেণিকক্ষে আনন্দময় পরিবেশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।

সরকার যেসব উদ্যোগ নিতে পারে- টেলিভিশনে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, বারবার পাঠ্যবই পরিবর্তন না করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার উদ্যোগ নেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা, পাঠ্যক্রমে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ যুক্ত করা ও ‘ট্রমা কাউন্সেলিং’ কর্মসূচি আয়োজন করা।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধূরীর সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় অতিথি প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল, সদস্য, প্রাইমারি এডুকেশন কনসাল্টেশন কমিটির সদস্য চৌধুরী মুফাদ আহমেদ, ব্র্যাক-আইইডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইরাম মারিয়াম, প্রফেসর এম. নাজমুল হক, ডিরেক্টর। এ ছাড়াও উপস্থিত অতিথিদের অংশগ্রহণে উন্মুক্ত আলোচনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, এসএমসি সদস্য, উন্নয়নকর্মী, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, অভিযান সদস্য সংগঠন, এডুকেশন ওয়াচ, আইএনজিও, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশ নেন।

এসময় ড. এম এ মোহিত কামাল বলেন, শিশুদের জন্য সবকিছু নরমভাবে ব্যবহার করতে হবে। তাদের কোনো কিছু করতে জোর করা যাবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মনের যত্ন নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।  বলেন, সাম্প্রতিক এ আন্দোলনের ফলে শিশুদের ওপর প্রভাব পড়েছে। ক্ষমতা কাঠামো শিশুদের আবেগ বা মানসিক অবস্থাকে বুঝতে পারেনি বা চায়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজেরা সংগঠিত হয়েছে। সে জন্য শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
সমাপনী বক্তব্যে রাশেদা কে. চৌধূরী বলেন, শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে। সে জন্য আমরা মতবিনিময় সভা থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরবো, যাতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.