সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের বিধান সংক্রান্ত সংবিধানের বহুল আলোচিত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ থেকে বাতিল ২ থেকে ৮ উপ-অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল (রিস্টোর) করে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ রায় দেন। এই রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া যাবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ে গত সরকারের সময় যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, এই রিভিউ রায়ের মধ্যদিয়ে তার অবসান ঘটলো।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হলে সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে টানাপড়েন তৈরি হয়। এরপর এক রিট মামলার রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে আপিল বিভাগ।
২০১৭ সালের ওই রায়েই বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলা হয়। তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চের ওই রায় সরকারের সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের টানাপড়েনে নতুন মাত্রা দেয়। রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও পরে আর শুনানির উদ্যোগ নেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি অপসারণে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং রিভিউ আবেদন ঝুলে থাকায় গত সাত বছরে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আর গঠন হয়নি। ফলে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরও হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত ঝুলে রয়েছে পাঁচ বছর ধরে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের ‘দোসর’ বিচারকদেরও অপসারণের দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে গত সপ্তাহে ১২ জন বিচারককে আপাতত বেঞ্চ না দেয়ার সিদ্ধান্ত দেন প্রধান বিচারপতি। তখনই ষোড়শ সংশোধনী মামলা ফের আলোচনায় আসে। আন্দোলনের সূত্র ধরে ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ আবেদনটি রোববার আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে অংশ নেন। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানি করেন।

২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। ওই বছরের ২২শে সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ন্যস্ত করে সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। সে রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ই মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের দেয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৮শে নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। সে আপিলের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৩রা জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে রায় দেন। বহুল আলোচিত ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে, দেশের গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। তবে আপিল বিভাগের দেয়া সে রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রাষ্ট্রপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদনে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে ৯৪টি যুক্তি দেখিয়ে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চাওয়া হয়েছিল।

আপিল শুনানিতে আদালতে মতামত উপস্থাপনকারী ১০ অ্যামিকাস কিউরির (আদালতের বন্ধু) মধ্যে শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অপর ৯ অ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
২০১৬ সালের ৫ই মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করেন। ২০১৬ সালের ১১ই আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

No comments

Powered by Blogger.