মুরাদনগরে যত অপকর্মে জড়িত সাবেক এমপি হারুন
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে পালিয়ে গেছেন তিনি। ভুক্তভোগীরা বর্তমানে হারুন ও তার স্বজনদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন তার স্ত্রী ও ছেলের নামেও দেশে-বিদেশে গড়েছেন কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ। তার কথার বাইরে মুরাদনগরে টুঁ শব্দ করা যেতো না। কেউ প্রতিবাদ করলে হামলা-মামলার শিকার হতে হতো। থানা পুলিশ, প্রশাসন সব কিছু চলতো তার হাতের ইশারায়।
বালু মহাল নিয়ন্ত্রণ: হারুন ২০১৪ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর মুরাদনগর উপজেলা ২২টি ইউনিয়নের ৫ শতাধিক ড্রেজার মেশিন দিয়ে ২ হাজার একর জমির বালু উত্তোলন নেয়। তার বালু মহালের নিয়ন্ত্রণ করতো সাবেক মুরাদনগর উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সরকার ওরফে টিয়া রফিক, ধামঘর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কাদের, নজরুল মেম্বার, আরিফুল ইসলাম শাহেদ, রুহুল আমিন, জে আই জুয়েল ও বেলালসহ একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট বালু উত্তোলনের নামে কৃষকের তিন ফসলি জমির মাটি কেটে অন্যত্র বিক্রি করতো। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানায়, ২০১৪ সালে মুরাদনগর উপজেলায় ২৪ হাজার হেক্টর জমি ছিল। এখন আছে ২১ হাজার হেক্টরের একটু উপরে। এ এলাকায় ২ হাজার হেক্টর জমি বিলীন হয়ে গেছে। এই বালু মহাল থেকে প্রতিদিন ৫ লাখ টাকা পেতেন হারুন।
টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ: মুরাদনগর উপজেলার সব ধরনের টেন্ডার ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের কব্জায় ছিল। এসব ধামঘর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কাদের তার একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী দেখভাল করতেন।
সরকারি অফিস নিয়ন্ত্রণ: নিয়োগ, বদলিসহ সরকারি অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হতো তার নির্দেশমতো। দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায় উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ, ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতেন তিনি। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রমও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
নির্বাচনে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়: আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে নিতেন ৮ কোটি, ভাইস চেয়ারম্যান থেকে নিতেন ৫ কোটি ও ইউপি চেয়ারম্যানদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও একক প্রার্থী ঘোষণা করে ৩০ লাখ টাকা নিতেন ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন।
বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা: ২০১৪-২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর অসংখ্য মামলা দিয়েছেন হারুন। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটি ভাইস চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা-৩ আসনের ৫ বারের এমপি আলহাজ শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদকে ২০০৪ সালে ঢাকায় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে গ্রেনেড হামলা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তার ৫ ভাইয়ের বিরুদ্ধে গাড়ি ও বাড়িতে হামলা-মামলা, উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক মোল্লা মজিবুল হকের বাড়িতে হামলা-মামলা, ইউপি সদস্য বাদশা, যুবদল নেতা মাসুদ রানা ও আলমগীর হোসেনকে মারধর করে হাত-পা ভেঙে দিয়েছেন।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা-মামলা: দৈনিক মানবজমিন সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ, ইত্তেফাক পত্রিকার সাংবাদিক মোশাররফ হোসেন মনির, কালের কণ্ঠ সাংবাদিক ও প্রফেসর আজিজুল হক রনি, আমাদের সময় সাংবাদিক হাবিবুর রহমান, ভোরের পাতা সাংবাদিক শামীম আহমেদ, দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার সাংবাদিক রায়হান চৌধুরী, এশিয়ান টিভির সাজ্জাদ হোসেন শিমুল ও ঢাকা প্রতিদিন পত্রিকার সাংবাদিক ফয়জুল ইসলাম ফয়সালের ওপর হামলা-মামলা দিয়ে হারুনের নির্দেশে তার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীরা কোণঠাসা করেছেন। কোম্পানীগঞ্জ বাজারের ভুক্তভোগী আলম আমিন, হাবিব, হোসেন, শাহ জাহান, পিন্টু, মহিউদ্দিন, কামাল আশিক ও নজরুলের অভিযোগ, কোম্পানীগঞ্জ গোমতী বেড়িবাঁধের সামনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমিতে ১ বছরের জন্য ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় ইজারা নিয়ে ১৩৫টি দোকান তৈরি করে প্রতিটি দোকান ১৪-১৫ লাখ টাকা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন হারুন ও তার সন্ত্রাস বাহিনী ভুবনঘর গ্রামের নজরুল ইসলাম মেম্বার। এ ছাড়া উপজেলা সদরে গোমতী মার্কেটে শতাধিক দোকান বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কর্ণফুলী নদীর তীরে লালদিয়ার চরে ‘মেসার্স ইনকন ট্রেড লিমিটেড’ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যান্ড কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন ৮ একর জমি দখল করে হারুন গড়ে তুলে।
চাঁদাবাজি মামলা: কুমিল্লা বিজ্ঞ-আদালতে আলমগীর হোসেন ও এডভোকেট মো. মহসিন বাদী হয়ে সংসদ সদস্য ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন (এফসিএ) সহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও মুরাদনগর সদর ইউনিয়নের দরিকান্দি ৪০০ একর জমিতে মাছের প্রজেক্ট দখলের প্রায় ১৭ লাখ টাকা চাঁদা নেয়ার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন।
দুদকের প্রতিবেদন: নর্থ সাউথ আট ট্রাস্টির বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছে। মামলার সূত্রে জানা গেছে, নর্থ সাউথ আট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হারুনের ছেলে তানভীর হারুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনে ব্যয় না করে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বিলাসবহুল ১০টি গাড়ি কিনেন। পরবর্তী এগুলো বিক্রির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ কোটি ৬৪ লাখ ৩৭ হাজার ২৫৫ টাকা এবং জ্বালানি ও চালকের বাবদ ৮৩ লাখ ২৮ হাজার ৫০৩ টাকাসহ মোট ১০ কোটি ৪৭ লাখ ৬৫ হাজার ৭৫৮ টাকা আত্মসাৎ করেন। এসব বিষয়ে জানতে আলহাজ ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। বর্তমানে তার মোবাইল নম্বর দুটি বন্ধ আছে।
No comments