দুদকে থমকে গেছে পুরনো অনুসন্ধান by মারুফ কিবরিয়া

গণঅভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পালাবদল হয় ৫ই আগস্ট। ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটে। ক্ষমতার পালাবদলে নতুনত্ব আসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যক্রমেও। সংস্থাটি নেমে পড়ে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে। একের পর এক নতুন অনুসন্ধানের ফাইলের স্তূপ কর্মকর্তাদের টেবিলে। ফলে ৫ই আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ের অনুসন্ধানের ফাইলগুলোর কাজে নেমে আসে স্থবিরতা।

সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, রাজস্ব বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছিল সংস্থাটি। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধানও শুরু হয়। কিন্তু গত  আড়াই মাসে সে অর্থে এসব অনুসন্ধানের কাজ খুব বেশি এগোয়নি। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পর দলটির এমপি-মন্ত্রীদের নিয়ে ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় কমিশনের।

এক দুদক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানান, তার  হাতে ৫ই আগস্টের আগে একাধিক অনুসন্ধান ও তদন্তের ফাইল ছিল। কিন্তু সরকার পতনের পর নতুন আরও দু’টি অনুসন্ধান করতে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বলেন, আগের কাজগুলো অর্ধেকের বেশি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন নতুন ফাইলের কাজের জন্য আগেরগুলো বন্ধই আছে।

অন্য এক কর্মকর্তা জানান, বিগত সময়গুলোর চেয়ে দুদকের কর্মকর্তাদের কাজের চাপ বেশি। তবে এই চাপ শুধু পতিত সরকারের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের কারণে। আগের অনুসন্ধানগুলোর খবর তো নেই। সেগুলোতে হাতই দেয়া যাচ্ছে না।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে ঢাকা ওয়াসার ছয়টি প্রকল্পে অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। এ ছাড়া নিয়োগ সংক্রান্ত একটি অনিয়মের অনুসন্ধানও করে সংস্থাটি। দু’টি অনুসন্ধান এক কর্মকর্তার অধীনে একাধিক কর্মকর্তা কাজ শুরু করেন। কিন্তু দুই বছর পার হওয়ার পরও তা শেষ হয়নি। এর মধ্যে শুধু নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে গত বছর মে মাসে ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানসহ ১০ জনকে আসামি করে মামলার সুপারিশ দেয়া হয়। কিন্তু সেটিও দুদকের এক কমিশনারের অনাগ্রহে করা যায়নি। শুধু তাই নয়, আইন অনুবিভাগের অনাপত্তি সত্ত্বেও অনুসন্ধানের কার্যক্রমে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধানের এক কর্মকর্তা বলেন, ওয়াসার প্রকল্পে দুর্নীতি অনুসন্ধানটি অনেক বড়। কয়েকশ’ নথি সংগ্রহ করতে হয়েছে। তবে এর মধ্যে নতুন করে সরকার পরিবর্তন হওয়ায় এখন কমিশনের পক্ষ থেকে কাজের ধরন পাল্টেছে। কমিশন নতুন করে সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের ফাইল ওপেন করেছে। ফলে আগের অনুসন্ধানগুলোর কাজ আপাতত করা হচ্ছেই না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজার ফি (রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ নেয়া অর্থ) তহবিলে জমা না দেয়া, বিল-ভাউচার ছাড়া ব্যয়, যন্ত্রপাতি না কেনা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে অর্থ পরিশোধসহ বিভিন্ন খাতে অনিয়ম ধরে অন্তত ২৪৬ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে গত বছর অনুসন্ধানে নামে দুদক। এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে তা শেষ হয়নি।  এর মধ্যে বিএসএমএমইউ’র একাধিক কর্মকর্তাকে তলবও করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি সরকার পতনের কারণে নতুন ফাইল তৈরি হওয়ায় এই অনুসন্ধানটিও করতে পারছেন না বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র আরও জানায়, চলতি বছর সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। এর মধ্যে বেনজীরের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলা করলেও মূলত সম্পদের অনুসন্ধানের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি সংস্থাটি। দুদকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত শতাধিক প্রভাবশালীর সম্পদের খোঁজ শুরু করায় বেনজীরের ফাইলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছে কমিশন। অন্যদিকে রাজস্বের সাবেক কর্মকর্তা মতিউরের ফাইলের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

এ মুহূর্তে যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে: গত ১৩ই আগস্ট থেকে আওয়ামী লীগ আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ), নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান, রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে। এর মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে দুদক।

এ ছাড়াও আছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের নামও রয়েছে অনুসন্ধান তালিকায়।
অন্যদিকে সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভু, নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, অসীম কুমার উকিল, অপু উকিল, শাহে আলম তালুকদার, ডা. মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম আজাদ, সোলায়মান হক জোয়াদ্দার (ছেলুন), ইকবালুর রহিম, মো. সাইফুজ্জামান শেখর, তানভীর ইমাম, এনামুল হক, মো. আখতারুজ্জামান বাবু, শফিকুল ইসলাম শিমুল, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ হাবিব হাসান, মো. নুরুল ইসলাম তালুকদার, আব্দুল ওদুদ, আয়শা ফেরদৌস, রণজিৎ কুমার রায়, সাদেক খান, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, নাছিমুল আলম চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা, মো. আবু জাহির, এইচ বি এম ইকবাল, সোলায়মান জোয়ার্দার, শাহীন চাকলাদার, এইচ এম ইব্রাহিম ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তমাল মুনসুরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

অনুসন্ধান তালিকায় আরও আছেন- নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র জহুরুল ইসলাম চাকলাদার। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার প্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক ডিআইজি আব্দুল বাতেন, এনএসআই’র সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) টি এম জোবায়ের, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকু, বিএফআইইউ’র সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, বিসিআইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান হাইয়ূল কাইয়ূম ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব আরজিনা খাতুনের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। অন্যদিকে বিএসএমএমইউ’র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিরীণ আখতারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.