শেখ হাসিনার সহযোগীরা ১৭ বিলিয়ন ডলার সরিয়েছে

একে পুরোপুরি ব্যাংক ডাকাতি বলা যায়। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে তার ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররা ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ১৭০০ কোটি ডলার পাচার করেছেন। এতে সহায়তা করেছেন ওই সময়ের ডিজিএফআই’র কিছু কর্মকর্তা। সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতি হিসেবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মানসুর। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে কীভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এ সময়ে তার একটি চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন লন্ডনের দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। তার এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ হওয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে চারদিকে। কীভাবে একটি সরকারের ঘনিষ্ঠজনরা গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় এত বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে তা নিয়ে বিস্মিত অনেকে। সাক্ষাৎকারে গভর্নর বলেছেন, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ধনকুবেররা দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে পাচার করেছেন প্রায় ১৭০০ কোটি ডলার। এসবই হয়েছে শেখ হাসিনার শাসনামলে। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র কিছু কর্মকর্তা সহায়তা করেছেন। যারা এভাবে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তার মধ্যে বহুল আলোচিত সাইফুল আলম ওরফে এস আলমের নাম আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মানসুর বলেন- শেখ হাসিনা আগস্টে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, শুধু অর্থ পাচারই নয়। শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলোকে দখলে সহায়তা করেছে ডিজিএফআই’র কিছু সদস্য। গভর্নর মানসুরের অনুমান এসব ব্যাংক দখল করার পর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন বা ১৬.৭ বিলিয়ন ডলার তুলে নেয়া হয়েছে।

এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে নতুন শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ঋণ পদ্ধতি এবং আমদানি চালান স্ফীত করে দেখানোর মাধ্যম। গভর্নর আরও বলেন, যেকোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এটি হচ্ছে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতি। এর পেছনে রাষ্ট্রীয় মদত ছিল। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সহায়তা ছাড়া এটা কখনো ঘটেনি। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ব্যাংকগুলোর সাবেক প্রধান নির্বাহীদের মাথায় অস্ত্র না ধরলে এটা হতে পারে না। গভর্নর মানসুর আরও বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এস আলম শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা ডিজিএফআই’র কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন। তারপর এসব ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে তারা সর্বনিম্ন ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। প্রতিদিনই তাদের নামে ঋণ অনুমোদন দিয়েছেন তারা নিজেরা। সাইফুল আলমের পক্ষে আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন ইমানুয়েল উরকুহার্ট অ্যান্ড সুলিভান এক বিবৃতিতে বলেছে, গভর্নর আহসান মানসুরের অভিযোগ অসত্য। এস আলম গ্রুপ এবং বাংলাদেশে নেতৃস্থানীয় আরও কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকার যে সমন্বিত প্রচারণা চালাচ্ছে তাতে যথাযথ প্রক্রিয়ার মৌলিক নীতির প্রতি সামান্যতম সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এর ফলে এরই মধ্যে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে তা ভূমিকা রাখছে। তারা বলে, কোম্পানির রেকর্ড ও অবদানের প্রেক্ষিতে গভর্নর যে বক্তব্য দিয়েছেন তাকে আমরা বিস্ময়কর ও অযৌক্তিক বলে মনে করছি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিডিয়া বিষয়ক অনুসন্ধানের বিষয়টি দেখাশোনা করে ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স ডিরেক্টরেট। তাদের কাছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস মন্তব্য চাইলে কোনো সাড়া দেয়নি। এ ছাড়া মন্তব্যের জন্য ডিজিএফআই’র সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি তারা। টাইমস আরও লিখেছে, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে মোট দুই দশক ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ হলো- বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ গার্মেন্ট রপ্তানিকারক। তার এই শাসন ভোট জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত, বিরোধীদের জেল ও নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত এবং ব্যাপক পরিমাণ দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। আগস্টে তিনি পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন তা অজানা। এদিকে তিনি পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে এসেছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপরই শেখ হাসিনার শাসকগোষ্ঠীর সদস্য এবং তাদের সহযোগীরা যেসব সম্পদ অন্যায়ভাবে সংগ্রহ করেছেন তা ফেরত আনার প্রত্যয় এই সরকার বার বার ঘোষণা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের একজন সাবেক কর্মকর্তা আহসান মানসুর। তিনি বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।

গত মাসে তিনি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, শেখ হাসিনার মিত্রদের বিদেশি সম্পত্তির বিষয়ে তদন্তে বৃটেনের সহায়তা চেয়েছেন। অভিযোগ আছে, শেখ হাসিনার শাসনের অধীনে শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের টার্গেট করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন পরিচালনা পরিষদের সদস্যদেরকে তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য স্থানে, যেমন হোটেলে। এরপর অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাদের শেয়ার ‘মিস্টার এস আলম’-এর ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে বলা হতো। তাদেরকে পরিচালনা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে বলা হতো। একটির পর আরেকটি ব্যাংকে তারা এটা করেছে।
একটি ব্যাংকের সাবেক একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, জোরপূর্বক তাকে তুলে নিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সবচেয়ে অন্যতম বড় ঋণদাতা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ২০১৩ সালের তখনকার সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে তিনি চাপের মুখে ছিলেন। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে যে নাম পাঠানো হবে তাদেরকে পরিচালনা পরিষদে রাখার চাপ দেয়া হয়। ব্যাংকের একজন বিদেশি পরিচালকের ব্যবহৃত হোটেল রুমে সরকারি এজেন্সির লোকজন তল্লাশি চালিয়েছিল। মান্নান আরও বলেন, ২০১৭ সালে পরিচালনা পরিষদের এক মিটিংয়ে যাওয়ার পথে তার গতিপথ পাল্টে দেয়া হয় এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ক সিনিয়র এক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাকে জোরপূর্বক পদত্যাগে পুরো একটি দিন সেখানে রাখা হয়। তিনি আরও বলেন, ভুয়া স্টেশনারির কাগজে তারা ব্যাংকের কাগজপত্র প্রস্তুত করে। উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ার নিযুক্ত করেছিল। তিনি বলেন, এরপর আমাকে একটি কাগজে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়।

গত এক দশক ধরে ব্যাংকিং খাতে বৈচিত্র্য আনেন এস আলম। তার গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তারা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ সাতটি ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে।

গভর্নর মানসুর বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের সময় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া প্রায় এক ডজন ব্যাংকে অডিট সম্পন্ন করার পর চুরি করা অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ আদালতে আমরা তথ্যপ্রমাণ হিসেবে এসব অডিট রিপোর্ট ব্যবহার করতে চাই। শেখ হাসিনা শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিক্রি আটকে দেয় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। মানসুর বলেন, কর্তৃপক্ষ এখন ভালো মানের জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের পুনঃপুঁজির জন্য ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ পরিচালনা বা নিষ্পত্তি করার জন্য একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ফার্ম স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। তিনি বলেন, পাচার করা এই অর্থ ফেরত আনতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া করবে। দুবাই, সিঙ্গাপুর, বৃটেনে এবং অন্যত্র যেসব শেয়ারহোল্ডারের সম্পদ আছে তা পুনরুদ্ধারেরর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.