সংবিধান পুনর্লিখন নয় সংশোধন করা বাঞ্ছনীয়
মতবিনিময় সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন- সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল এবার যাতে বেহাত না হয়, সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনকে যে নামেই ডাকেন, এটি একটি সফল আন্দোলন। যে কারণে মানুষের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসা স্বৈরশাসককে দেশ থেকে পালাতে হলো। এই যে সরানো হলো, এটি হলো সাংবিধানিক অধিকার। সব অধিকার লেখা থাকে না। এ বিষয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও উদাহরণ তুলে ধরেন। বিচারপতি মতিন বলেন, শাসনতন্ত্রের সংস্কার বলেন, পুনর্লিখন বলেন, যা-ই বলেন, এটির অধিকার কার? অধিকার তাদেরই, যারা এই পরিবর্তন (সরকার পরিবর্তন) এনেছেন।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। সে বিষয়টি উল্লেখ করে বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, পাঁচ বছর পর হলেও গণতন্ত্রের একটু স্বাদ পেতাম। (আগে) নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল না। একটি ব্যবস্থা করা গেল ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় দু’-তিনটি নির্বাচন ভালোই করলাম। পরে সেটি আবার বেহাত হয়ে গেল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও অপপ্রয়োগ (অ্যাবিউজ) হয়েছে উল্লেখ করে বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, এটিকে মেরামত করা যেত। কিন্তু এটিকে এমনভাবে বাধাগ্রস্ত (ব্যারিয়ার) করা হলো, নির্বাচন বলতে কিছুই থাকলো না। ২০১৪ সালে একটি নির্বাচন হলো, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো না, ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন। এরপর ২০১৮ সালে দেখা গেল রাতের বেলায় ভোট হয়ে গেল। আর ২০২৪ সালে দেখা গেল ‘ডামি নির্বাচন’। ত্রয়োদশ সংশোধনী যদি থাকত, অন্তত মন্দের ভালো একটি নির্বাচন হতে পারতো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, যারা ক্ষমতায় যায়, তাদের নির্বাচনের প্রতি একটি ভয় যে নির্বাচন করা মানে চলে যাওয়া।
সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে বিচারপতি মতিন বলেন, ইতিমধ্যে যেগুলো স্বীকৃত বা মীমাংসিত বিষয়, এগুলোতে মনে হয় হাত দেয়া ঠিক হবে না। যেমন ‘রিপাবলিক’। এগুলো বিদ্যমান রেখে এখান থেকে আরম্ভ করতে হবে। যেগুলো না করলেই নয়, সেটির সংস্কার করার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বিচার বিভাগকে মেরামত করা, এগুলোতে হাত দিতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মো. দস্তগীর হোসাইন বলেন, এত সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন হলো, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। পরবর্তী সময়ে কী পেলাম? ফল শূন্য। এই ছাত্র-জনতা যদি এগিয়ে না আসতো, তাহলে যে গর্তে পড়েছিলাম, সেখানেই থাকতে হতো।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে নতুন সুযোগ এসেছে উল্লেখ করে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্?ফুজ আনাম বলেন, একটি বক্তব্য এসেছে, আমরা কি নতুনভাবে সংবিধান লিখবো, নাকি আগেরটি সংশোধন করবো। আমার মত হচ্ছে- আগেরটার সংশোধন করাই বাঞ্ছনীয়। কেননা, আগেরটির মধ্যে অনেক মূল্যবান বক্তব্য আছে। ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি আছে। এটিকে আরও গণতান্ত্রিক করা, আরও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের সরকার না আসে, যারা সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে। এজন্য সংশোধন দরকার।
সংবিধান সংশোধনে কী কী করা যেতে পারে, সে বিষয়েও কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন মাহ্ফুজ আনাম। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণের ( সেপারেশন অব পাওয়ার) ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, বিচার বিভাগের ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে খর্ব হয়েছিল। আইন বিভাগ স্বাধীন দায়িত্ব পালন করেনি। সেটি ক্ষমতাসীন দলের ‘রাবার স্ট্যাম্প’ হিসেবে কাজ করেছে। সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে গিয়েছিল নির্বাহী বিভাগের কাছে। সেটির পরিবর্তন অবশ্যই করতে হবে। মাহ্ফুজ আনাম বলেন, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা, সর্বোপরি সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, সেটি নির্ধারণ করে বিচার বিভাগ। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন দরকার। গণমাধ্যম যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেটি দরকার। নতুন নতুন আইন করে গণমাধ্যমকে কুক্ষিগত করা হয়েছিল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। সর্বশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং পরে সেটির পরিবর্তে সাইবার নিরাপত্তা আইন বলতে গেলে গণমাধ্যমকে হত্যা করার প্রয়াস। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মনে করেন মাহ্ফুজ আনাম।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, বর্তমানে যারা সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন সংবিধান লিখতে চাচ্ছেন, তা তাদের এখতিয়ারে নেই। তবে সংবিধান সংশোধন হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। পরামর্শ সভায় আরও বক্তব্য দেন- আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের সভাপতি সিএএফ দৌলা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী উত্তম কুমার দাস, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ।
No comments