‘১৫ বছর মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি’ -কারাগার সংস্কার কর্মশালা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেছেন, বিগত ১৫ বছর মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। ভয়ের সংস্কৃতি ভয়ের শাসন ও ফ্যাসিবাদের কারণে স্বাধীনভাবে কথা বলা সম্ভব হয়নি। গতকাল ‘কারাগার সংস্কার: বাস্তবতা ও করণীয়’- শীর্ষক কর্মশালায় তিনি এ কথা বলেন। আদিলুর রহমান খান বলেন,   মানবাধিকার নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন করায় তাকে দু’বার জেলে যেতে হয়েছে। প্রথমবার তাকে তুলে নেয়া হয় এবং রিমান্ড শেষে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। দ্বিতীয়বার মামলায় দুই বছরের দণ্ড দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তিনি বলেন, কারাগারগুলোকে সংস্কারের চেষ্টা করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্যোগী হতে হবে। এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করতে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সুপারিশ করবে। আপিল  বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশন কাজ করছে।

উপদেষ্টা বলেন, দেশে বহু নির্যাতিত মানুষ রয়েছে। আদালত থেকে নির্যাতিত মানুষেরা যেন বিচার পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কুষ্টিয়া আদালতে মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান রক্তাক্ত হয়েছেন ওই ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে।

বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, বাংলাদেশের জেল কোড ১৯৮৯ সালে সর্বশেষ পুনঃমুদ্রিত হয়েছিল। বিভিন্ন সংস্থাকে সম্পৃক্ত করে কারা সংস্কারে উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে কারাগার আমাদের সমাজেরই অংশ। কারাবন্দি একজন মানুষের শুধু ফ্রিডম অফ মুভমেন্ট থাকবে না। তার ভোটাধিকার বা অন্যান্য ফ্রিডম রেস্ট্রিকটেড থাকবে না। এ বিচারপতি বলেন, রায় মানতে দেশের প্রতিটি নাগরিক বাধ্য। রায়ের সমালোচনা করার অধিকার সবার রয়েছে। কারা ব্যবস্থাপনা যুগোপযোগী করতে গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন,  কারা আইন সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। মানবিকভাবে কারাগারগুলোকে গড়ে তুলতে হবে। জেল কোড ও দণ্ডবিধি সংশোধন করে যুগোপযোগী করা এখন সময়ের দাবি। তিনি তার কারাজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। কারাগারের ভিতরে দুর্নীতি এবং বিভিন্ন বৈষম্য তুলে ধরেন ব্যারিস্টার কাজল।
আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, কারাবন্দিদের সংশোধনের সুযোগ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরেন। কারাগারে নারী ও শিশুরা নানা ধরনের বৈরী আচরণের মুখোমুখি হন। তিনি বিদ্যমান কারাব্যবস্থা সংস্কারের উপর জোর দেন।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহার হোসেন বলেছেন  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ১৭টি কারাগারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে সব কারাগারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দেশের সব কারাগারে এখন নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশ রয়েছে। তিনি কারা ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণে গুরুত্ব আরোপ করেন। কারাগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক থাকে বিভিন্ন সময় যা অমানবিক। এটি সমাধান জরুরি। কারা উপ- মহাপরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির বিদ্যমান কারাগার ব্যবস্থায় বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন।

কর্মশালায় মূল প্রস্তাবনা তুলে ধরে বক্তৃতা করেন এডভোকেট শিশির মনির। তিনি বলেন, কারগার মূলত সংশোধানাগার। কারাগারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- অপরাধীর সংস্কার বা সংশোধন। বর্তমানের  কারাগার ব্যবস্থা সংশোধনমূলক তত্ত্ব-নির্ভর। জেলগুলো মূলত ১৮৬০ সালের জেল কোড, দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট ও দ্য প্রিজনার্স অ্যাক্ট আইনসমূহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ঔপনিবেশিক আমলে আনা এসব আইন সংশোধন করে জেল ব্যবস্থা সংস্কার এখন সময়ের দাবি। তিনি কারাগার ব্যবস্থা যুগোপযোগী করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে কনডেম সেলে এবং কারাগারে নির্জন স্থানে রাখা আইনের লঙ্ঘন।

শিশির মনির বলেন, বন্দিদের কনডেম সেলে রাখা হয়, যখন তাদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়। এ ধরনের বন্দিদের মনস্তাত্ত্বিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক মানবিক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়, তাই এটি আইনের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে এবং বন্দির মানবাধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান রাখতে হবে। হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না।

শনিবার আইন, আদালত, মানবাধিকার ও সংবিধান বিষয়ক সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন ল্থ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) ও কারা অধিদপ্তর যৌথভাবে এ কর্মশালা আয়োজন করে। রাজধানীর কারা অধিদপ্তরের কনভেনশন হলে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এলআরএফ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান জাবেদের সভাপতিত্বে কর্মশালায় স্বাগত বক্তৃতা করেন- সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মিশন। কর্মশালা সঞ্চালনা করেন- প্রশিক্ষণ ও কল্যাণ সম্পাদক জাভেদ আখতার ও নিউএজ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সিনিয়র সাংবাদিক শহীদুজ্জামান।


No comments

Powered by Blogger.