রংবাজ থেকে হ্যামিলনের মুভিওয়ালা by শায়ের খান
ঢাকার মানুষের তখন বিনোদনের দু’চারটা জায়গা ছিল। ফুটবল, মুভি, পার্ক আর চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। ঢাকায় বাংলা ও ইংলিশ দুই মুভিই চলতো। ইংলিশ মুভি’র জন্য আলাদা স্পেশাল হল ছিল। মধুমিতা, অভিসার আর গুলিস্তান হলের পেটের ভেতরের নাজ হলে চলতো জনপ্রিয় আর অস্কার পাওয়া সব হলিউড মুভি - টু উইমেন, সানফ্লাওয়ার, হোয়্যার ঈগলস ডেয়ার, দ্য ডার্টি ডজেন, ম্যাকেনা’স গোল্ড, রেড সান, রোমান হলিডে, আওয়ার ম্যান ফ্লিন্ট, জেসি’জ গার্লসসহ শত শত মুভি। কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে রিকশাওয়ালা বা কথিত ‘লুঙ্গি পাট্টি’ও ইংলিশ মুভি দেখতো। মুভির খোলামেলা সীনে ফ্রন্ট স্টল থেকে হুইসেল চিৎকার শোনা যেতো বেশি। কিন্তু সেটাই কি চূড়ান্ত? মনে হয় না। উদাহরণ দেই। অস্কার পাওয়া ‘টু উইমেন’ ছবি চলছে অভিসারে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের পাশে ধর্ষিতা সোফিয়া লরেন তার ছোট্ট মেয়ের জন্য এক মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু খাবার হবে? মহিলা বুকের কাপড় ছিঁড়ে স্তন উন্মুক্ত করে চিৎকার করে বললেন, আমার বাচ্চার জন্যই খাবার নেই, তোমার মেয়েকে দেবো কীভাবে? কোনো হুইসেল-চিৎকার নেই। সব চুপ। শুধু আহা, ইশশ-জাতীয় কষ্টের কমেন্টস আসছে। তবে কী রিকশাওয়ালারা ইংলিশ বুঝতো? না, বুঝতো না। তাদের ছিল বাংলাদেশি রক্ষণশীল মূল্যবোধ। বাংলা মুভির ছিল দুই ভাগ- সামাজিক ও বাণিজ্যিক। মধ্যবিত্ত ও রুচিশীল পরিবারের পছন্দ ছিল সামাজিক ছবি। আর এই ছবিগুলোই বেশি মুক্তি পেতো।
নাসার বিজ্ঞানীদের মতো আমাদের ছিল একঝাঁক তীক্ষ্ণধার পরিচালক- জহির রায়হান, এহতেশাম, মুস্তাফিজুর রহমান, খান আতাউর রহমান, আমজাদ হোসেন, সুভাষ দত্ত, আজিজুর রহমান বুলি, শেখ নজরুল ইসলাম, মিতা, এমএ. সামাদ, এসএম. শফি, এ. জে. মিন্টুসহ শত শত। শুক্রবার মুক্তি পেতো নতুন মুভি। হলগুলোর সামনে দর্শক আর টিকিট ব্ল্যাকারদের ‘অই ডিসি ডিসি- রিয়াল রিয়াল’ হাঁকডাক জানান দিতো- এলাহী কারবার ঘটছে এখানে। সিনেমা হলে হলে ছেয়ে গেছিল বাংলাদেশ। যেখানে সিগারেট, সেখানেই ম্যাচ। যেখানে বার্গার, সেখানেই সফ্ট ড্রিঙ্কস। এদেশে ব্যবসা করতে আসা চীনারা এটা ভালো জানতো। তারা সিনেমা হলের সঙ্গে জুড়ে দিতে লাগলো চীনা রেস্তরাঁ। ঢাকার প্রথম চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ‘চু চিন চৌ’ বসে গেল গুলিস্তান হলের সঙ্গে। বলাকা হলের দোতলায় ‘ইফা’ আর তিনতলায় ‘বাং চিং’ আসন গাড়লো। মধুমিতা হলে বসে গেল ‘টাই টুং’। চীনারা ব্যবসা জানে। মজা বেশীদিন থাকে না। অভিনেত্রী শাবানা ছিলেন মধ্যবিত্তের আদর্শ লক্ষ্মী মেয়ে। তাকে একদিন পরিচালক সাগরের পানিতে কোমর ভিজিয়ে নাচিয়ে গাইয়ে দিলেন, ‘ও দরিয়ার পানি, তোর মতলব জানি’। কেঁপে উঠলো দর্শক। চিটাগাংয়ের যাত্রা মঞ্চ থেকে উড়ে এলেন অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষ। উপুড় করা কলসীর উপর পা রেখে সুডৌল শরীর বাঁকিয়ে গেয়ে উঠলেন, ‘চাকভুম চাকভুম চাঁদনী রাতে, কিছু বলবো তোমায় চোখের ভাষায়’। দর্শকের চোখের তারা নেচে উঠলো। আস্তে আস্তে মুভির ভাষা আর নাম পাল্টাতে লাগলো। যেখানে বাংলা ছবির নাম ছিলো- আবার তোরা মানুষ হ, মনের মতো বৌ, জীবন থেকে নেয়া, সূর্য কন্যা, সেখানে নাম হতে লাগলো- নরম গরম, গরম মশলা, রসের বাইদানী। রুচিশীল মধ্যবিত্ত হল ছাড়লো।
যেখানে হলিউডের গ্রেগরি পেক, অ্যান্থনি কুইন, ডেভিড নিভেন, সোফিয়া লরেন, অড্রে হেপবার্ন, এলিজাবেথ টেইলরদের ইংলিশ মুভি আসতো, সেখানে আসতে লাগলো নাম না জানা সব ইংলিশ মুভি। এসব মুভির সঙ্গে জুড়ে দেয়া থাকতো অশ্লীল দৃশ্য। এর নাম ‘কাটপিস’। কাটপিসের ঢেউ লাগলো বাংলা ছবিতেও। বানানো হতে লাগলো অশ্লীল বাংলা ছবিও। রুচিশীল সব দর্শক হল থেকে সরে গেল। বিপদে পড়লো হল মালিকেরা। বছরের পর বছর লস গুনতে লাগলো। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে লাগলো- সিনেমা হলগুলো ভেঙে মার্কেট বানানো হচ্ছে। দেশের মুভি ইন্ডাস্ট্রির জন্য শুরু হলো অশনি সংকেত। ‘অশনি সংকেত’ একটা মুভিরও নাম। সত্যজিতের। প্রধান দুই চরিত্রের একজন ছিলেন আমাদের ববিতা। এক জোড়া রানিং শু দরকার। জুতোর দোকান সব ঘুরে দেখছি। এলিফ্যান্ট রোডের মল্লিকা সিনেমা হলের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। মল্লিকা হল এখন আর হল নেই। বহুতল মার্কেট হয়ে গেছে। ঢুকলাম। শখের জুতোটা পেয়েও গেলাম। হাঁটছি আর ভাবছি, একসময় স্কুল কলেজ ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে হলে ঢুকতাম, এখন হল ভাঙা মার্কেট থেকে দৌড়ের জুতা নিয়ে বের হচ্ছি। সময় কি উল্টে গেছে? না, সময় উল্টায় না, মানুষ উল্টায়। জাতি পেয়েছে এক নতুন দেশের ঠিকানা। এই নতুন দেশেই আবার তৈরি হবে উন্নত সব মুভি। আমরা এমন সব মুভি বানাবো যেগুলোর জন্য হল ভেঙে বানানো মার্কেটগুলোয় সিনেমা হল গড়ে উঠবে। হলিউড থেকে আর মুভি আনতে হবে না, আমাদের মুভিই হলিউড রিমেক করবে। ১৮ কোটির দেশে ১৮ জন বিশ্বখ্যাত সুপারস্টার আর ১৮ দুগুণে ৩৬ জন অস্কার স্ট্যান্ডার্ডের নির্মাতা বের করাটা তুড়ির বিষয়। মুভি’র রিসেট বাটন পুশ করা হয়ে গেছে। একটু অপেক্ষা করতে হবে শুধু।
লেখক-নাট্যকার-ফিল্মমেকার
No comments