এমন করে কি টিকতে পারে কেউ? by ইমরান আলী
ক্ষমতার মোহে মানুষ অন্ধ হয়। তবে এ অন্ধ আবার ভিন্ন ধাঁচের। ভাবে নিজে যেহেতু দেখছে না তাই কেউই টের পাচ্ছে না। দিনের পর পর দিন মিথ্যা বলে গেল। সত্য প্রচার রোধে বন্ধ হলো ইন্টারনেট সাথে আবার যানবাহনও। ‘সন্ত্রাসীদের আগুনে ডেটা সেন্টার পুড়ে’ যাওয়ার গল্পও ফাঁদা হলো।
এরপর আবার বন্ধের স্বীকারোক্তি দিয়ে বলা হলো-জাতীয় ও নাগরিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। দেশ যখন ডিজিটালি স্মার্ট করার চেষ্টা করছেন বলে প্রচার চলছে তখন কিনা তথ্য প্রবাহ, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিল তারাই। আবার এই ব্যাখ্যাও দেয়া হলো- গুজব রোধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করেছে। গুজব ঠেকাতে এসব অফ-অনের খেলা চলতে থাকলো।
ওদিকে মন্ত্রী মহাশয় নিজেই সবার কানেকশন বন্ধ করে একের পর এক সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিতে থাকলেন। গুজব প্রতিরোধে মানুষকে সঠিক তথ্য জানাতে তিনি নাকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় রয়েছেন। পুরো দেশের ‘সঠিক’ খবর প্রচারের দায়িত্ব নিলেন তিনি একাই! এই অধিকার তাকে দিল কে? জবাবদিহিহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আসলে এমনই হয়। যাচ্ছে তাই করা যায়। টুটি চেপে ধরা যায়।
ছাত্রলীগকে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে নামিয়ে দিলেন আরেক মন্ত্রী। অবশ্য তিনি নিজেই এখন পলাতক। বিস্ময় নিয়ে দেশের মানুষ ভেবেছে-কীভাবে সম্ভব নিজ দেশের সন্তানের বিরুদ্ধে আরেক সন্তানকে নামানো, গুলি চালানো! ক্ষমতায় টিকে থাকার লোভে কতোটা একগুঁয়ে হলে এমনটা হতে পারে!
জুলাই শেষ হতে থাকে। পরিস্থিতি দিনকে দিন কঠিনতর হয়। দেশ-বিদেশ থেকে আত্মীয় স্বজন ফোন করেন। খবর জানতে চান। ‘আজ একটা ছাত্র বা জনতা গুলিতে মারা যাননি’ এমন খবর চেয়ে বসেন। কিন্তু সে সুখবর দেয়া যায় না। সত্য প্রচার বন্ধে সব রাস্তা বন্ধ করলেও দিন শেষে খবর পাওয়া যায় ঠিকই। লাশের সংখ্যা বাড়তে থাকে। হাসপাতালে নিতেও কিনা বাঁধা দেয়া হয়। কতোটা অমানবিক হতে পারে মানুষ, রাষ্ট্রের চালকেরা।
দূর-দূরান্ত থেকে ফোনে প্রশ্ন করে মানুষ-আচ্ছা টিভিতে তো কোনো খবর পাচ্ছি না। সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছি কি? কিন্তু তাতো নয়। বন্ধ হয়নি গুলি, টিয়ারশেল, সাউন্ডগ্রেনেড, হত্যার খেলা। রাতারাতি টিভি থেকে সরে গেল সব খবর। চলতে থাকলো ঘুরে ফিরে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। নাটক, সিনেমা। লাশের কথা ভুলে, তথ্য চাপা দিয়ে এমনও কি হতে পারে! এমন করে কি রাষ্ট্র চলে?
বিদ্যুৎ বন্ধ রিচার্জের অভাবে। সকাল থেকে খা খা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়েছেন সাধারণ মানুষ। দশ-পনের ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরেছেন ঘরে। এমন করেই মানুষকে ‘টাইট’ দিতে চেয়েছিল সাবেক সরকার। বিরোধীদলগুলোর উপর নিপীড়নতো চালিয়েছে বছরের পর বছর। গুম-খুন, আয়নাঘর, কণ্ঠরোধ, মত প্রকাশে বাধা, অবিচার এর সবই যেন ছিল তাদের রুটিন কাজ।
কিন্তু এভাবে জুলুম করে যে টেকা যায় না, ইতিহাস মেনে নেয় না সেটা তারা আঁচ করেনি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে।
৪ আগস্ট দিনভর কাওরান বাজারে যে দৃশ্য দেখেছি তা ভাবলে এখনো শরীর শিউরে ওঠে। এমন দৃশ্য দেখা গেছে সারা দেশেই। পুলিশের সাথে ছাত্রলীগ অ্যাকশানে নেমেছে মাঠে। ছাত্র-জনতাকে দেখলেই দৌড়ে গেছে একসাথে মারতে। পুলিশের হাতে রাইফেল, বন্দুক। ছাত্রলীগের হাতে রামদা, লাঠি, হকিস্টিক। এর আগে চলেছে ঢালাও ধরপাকড়। থানার সামনে স্বজনদের আহাজারি। বিনা দোষে আটক করা হয়েছে সাধারণ মানুষের সন্তানদের। বাদ যায়নি শিশু থেকে প্রতিবন্ধীও।
দুনিয়া একদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আরেকদিকে। অবশ্য তার পাশে ছিল প্রতিবেশী আরেক বন্ধু। বন্ধুকে টিকিয়ে রাখতে কলকাঠি সেখান থেকেও কম নাড়া হয়নি এমনটাও বলাবলি আছে।
অবশেষে ৫ আগস্ট হাসিনা পালালেন। ততোদিনে ঝরেছে সহস্রাধিক তাজা প্রাণ।
সবারই মনে রাখা দরকার, ৫ আগস্ট থেকে শিক্ষা নেয়া কতটা জরুরি। এখানে ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই মুখ্য নয়। শান্তি-শৃঙ্খলা, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, সবার জন্য সমসুযোগ নিশ্চিত এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করাই রাজনীতিবিদদের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা ভুলে যাই সবকিছু। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে জেঁকে বসি জনগণের ঘাড়ে। আশা করি এমনটা না হোক আর। বিশ্বাস করতে চাই-এই দেশ নতুন করে আবার গড়ে উঠবে। সংস্কার আর নির্বাচন শেষে যে দল বা যারাই ক্ষমতায় আসুক তারা জনগণের প্রকৃত সেবক হবেন। ইতিহাস মনে রাখবেন।
No comments