গ্রামে গ্রামে খাবারের অপেক্ষা by মারুফ কিবরিয়া
আরেক স্বেচ্ছাসেবক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ত্রাণসামগ্রী আসছে অনেক। কিন্তু বাসাবাড়িতে অনেক মানুষ সেটা পাচ্ছেন না। মানুষ খাবারের কষ্ট করছে অনেক। আর বেশি পানি যেখানে সেখানে সেনাবাহিনী ও সরকারি সংস্থা ছাড়া কেউ যেতে পারছে না।
সরজমিন ফেনীর মাস্টারপাড়া, চাঁড়িপুর বিরিঞ্চি এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব সড়কে পানি বেশি থাকায় অনেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। দোতলায় অবস্থান করছেন অনেকে। তবে কমবেশি সবাই বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে ভুগছেন। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা খাবার নিয়ে দুই একবার এলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
বিরিঞ্চি এলাকার বাসিন্দা মো. ওমর ফারুক বলেন, শুনছি সারা দেশ থেকে খাবার আসছে। কিন্তু আমাদের লোকাল ভাইয়েরা যতটুকু পারছে করছে। এটা দিয়ে হয়না।
বন্যা পরিস্থিতি এখন যেমন: ফেনী শহর ও আশপাশের অনেক এলাকায় বানের পানি রয়ে গেছে। কমলেও তা ধীরগতি। অনেক স্থানেই বিদ্যুৎ ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক না থাকায় কেউ কারওর খোঁজ নিতে পারছেন না। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে এলেও প্রবল স্রোত ও রাস্তাঘাট চেনাজানা না থাকায় উদ্ধার কাজ চলছে ধীরগতিতে। তবে সেনাবাহিনী, বিজিবি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উদ্ধার অব্যাহত রেখেছে।
গতকাল সকালে দেখা যায়, শহরের এসএসকে সড়ক, ট্রাংক রোড, মিজান রোড থেকে পানি নেমে গেছে। পুরাতন জেল রোড, কলেজ রোড, ক্যাডেট কলেজ রোড, ডাক্তারপাড়া, মাস্টারপাড়া, রামপুর, পুরাতন পুলিশ কোয়ার্টার, শাহীন একাডেমি এলাকা, চাঁড়িপুর, বিরিঞ্চি, বনানীপাড়াসহ প্রায় সব এলাকা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। সদরের ১২ ইউনিয়নের ১০৮টি ওয়ার্ডের সব এলাকা পুরোপুরি বন্যাকবলিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী উপজেলায় পানি কমলেও রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। দাগনভূঞা ও সোনাগাজী উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা ডুবে গেছে। সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও লাখ লাখ মানুষ স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা বা উঁচু ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, সীমান্তবর্তী পরশুরাম পৌরসভার সীমান্ত এলাকা বাউরপাথর, সলিয়া, অনন্তপুর, চিথলিয়া ইউনিয়নের চিথলিয়া, অলকা, নোয়াপুর, ধনিকুণ্ডা, দুর্গাপুর, মির্জানগর ইউনিয়নের কাউতলী, চম্পকনগর, বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের সাতকুচিয়া গ্রামে জলাবদ্ধতার পর থেকে খাবার পাচ্ছেন না বাসিন্দারা।
একইভাবে ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর, বাঘাইয়া, সাতসতি, ইজ্জতপুর, মোটবী, গঙ্গানগর, ফাজিলপুর ইউনিয়নের শিবপুর, বটতলি এলাকায় কোনো ধরনের খাবার পৌঁছেনি।
জেলা প্রশাসক মোছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, কিছু এলাকায় পানি নামতে শুরু করলেও সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস এবং ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এরইমধ্যে এক হাজার ৬০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ফেনীতে সাড়ে ৫০০ টন চাল এবং ১০ লাখ টাকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় হতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণের অপেক্ষা: ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার জয়লস্কর ইউনিয়নের জয়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে মাঠ প্লাবিত। স্কুলটির নিচতলায়ও পানি ঢুকে গেছে। সরজমিন গতকাল গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকশ’ পরিবার। বানের জলে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন স্কুলে। তবে সবারই অপেক্ষা ত্রাণের গাড়ির। গাড়ি আসা মাত্রই স্কুলে আশ্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রতিনিধিরা হাজির হচ্ছেন। আশ্রয় নেয়া রোকসানা বেগম মানবজমিনকে বলেন, অনেকেই খাবার ব্যবস্থা করছে। বিজিবি’র গাড়ি থেকে দেয়া হয়। আবার ঢাকা থেকেও অনেকে এসে খাবার দিচ্ছে। কিন্তু বাথরুমের অসুবিধা বেশি হচ্ছে। মহিলাদের জন্য ব্যবস্থা থাকলেও অনেক মানুষ একসঙ্গে হওয়ায় কষ্ট বেশি হচ্ছে।
আশ্রয় নেয়া কুতুব উদ্দিন মোল্লা বলেন, আমাদের এখানে খাবার আসে। কিন্তু আশপাশের অনেক গ্রামের মানুষ বাড়ি থেকে আসেনি। তারা খাবারের কষ্ট করতেছে। আমাদের এখানে হাইওয়ের পাশে হওয়ায় মানুষ বেশি ত্রাণ দিচ্ছে।
জয়লস্কর থেকে এক কিলোমিটার দূরে সিলোনীয়া হাইস্কুল। এখানেও আশপাশের গ্রাম থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকশ’ পরিবার। আশ্রয় নেয়া কয়েকজন জানান, ত্রাণসামগ্রী এলেও পানি ও ওষুধের সংকট আছে। সবাই খাবার দিচ্ছে কিন্তু সে অনুযায়ী বিশুদ্ধ পানি দেয়া হচ্ছে না।
সরজমিন দাগনভূঞার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল ঘুরে দেখা যায় গতকাল বিকাল পর্যন্ত এসব এলাকায় বন্যার পানি বাড়ছিল। ফলে এসব এলাকার বাড়িঘরে অবস্থান করা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। উপজেলার নয়নপুর এলাকার ৫০ বছর বয়সী মোজাম্মেল হক বলেন, এত বন্যা এদিকে কখনো হয় নাই। গতকাল থেকে পানি বাড়তেছে। আমরা এখনো বাড়িতে আছি। ঘরের সামনে দুই ফুট পানি।
সেকান্দারপুর এলাকার বাসিন্দা নুরুল আমিন বলেন, বাড়ির ভেতরে পানি আছে। আজ রাতে মনে হয় ঘরে ঢুকবে। বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তায় আছি।
উপজেলার প্রতাপপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকার সব রাস্তাঘাট বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। সেখানে প্রতাপপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের তিনটি ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছেন ১৮০টি পরিবার। বিকাল ৫টার দিকে দাগনভূঞা উপজেলার আতাতুর্ক স্কুলের ১৯৯৬ সালের এসএসসি ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থীরা রান্না করা খাবার ও পানি বিতরণ করেন। সেখানে ৮০০ মানুষের জন্য খাবার দেয়া হয়। এ সময় আজমল হক সুমন বলেন, আমরা দাগনভূঞার বিভিন্ন স্থানে গত কয়েকদিন ধরে খাবার বিতরণ করছি। ব্যাচভিত্তিক বন্ধুরে উদ্যোগে এই কাজটির মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছি।
এ ছাড়াও দাগনভূঞার পাশাগ্রুপ, ব্রিকফিল মালিক সমিতিসহ অনেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
বন্যার সার্বিক অবস্থা প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিবেদিতা চাকমা মানবজমিনকে বলেন, প্রায় সত্তর হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছানো হচ্ছে। তবে বিক্ষিপ্তভাবে অনেকে বাসাবাড়িতে থাকায় তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।
No comments