ইসরায়েল–হিজবুল্লাহ পাল্টাপাল্টি হামলা: এখন কী হতে পারে

প্রথম আলোঃ ইসরায়েলে বড় পরিসরে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা। ইসরায়েলের দাবি, এমন তথ্য পেয়েই গত রোববার ভোররাতে আগেভাগে তারা লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর অবস্থানে হামলা চালায়।

লেবাননে ইসরায়েলের এই হামলার পর জবাব দিতে সময় নেয়নি হিজবুল্লাহ। তারা রোববার সকালে ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক ও গোয়েন্দা স্থাপনা নিশানা করে তিন শতাধিক রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।

হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ বলেন, গত জুলাইয়ের শেষ দিকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামলা চালিয়ে তাঁর সংগঠনের কমান্ডার ফুয়াদ শোকরকে হত্যা করে ইসরায়েল। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল সীমা অতিক্রম করেছে। শোকর হত্যার বদলা নিতে ইসরায়েলে হামলার আদেশ দেওয়া হয়।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী।

৮ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।

হিজবুল্লাহ বলেছে, গাজা যুদ্ধ থেকে ইসরায়েল সরে না আসা পর্যন্ত তাদের এমন হামলা বন্ধ হবে না।

এর মধ্যে গত রোববার দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটল।

বিষয়টি নিয়ে আল-জাজিরার পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। উত্তরগুলো জেনে নেওয়া যাক।

হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডার ধ্বংসের দাবি

ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডারে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ রকেট থাকার তথ্য পাওয়া যায়।

গত অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা নিশানা করে প্রায় ৮ হাজার রকেট ছুড়েছে হিজবুল্লাহ।

ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর হাজারো রকেট ধ্বংস করে দিয়েছে।

অন্যদিকে হিজবুল্লাহ বলেছে, ইসরায়েলের ১১টি সামরিক ঘাঁটি নিশানা করে তারা প্রায় ৩৪০টি কাতিউশা রকেট ছুড়েছে।

হাসান নাসরুল্লাহ বলেন, ইসরায়েল দাবি করে, এ অঞ্চলে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী আছে। কিন্তু ইসরায়েলের দাবি মিথ্যা। হিজবুল্লাহর হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের দুর্বলতার লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে গেছে।

বৈরুতের লেবানিজ-আমেরিকান ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইমাদ সালামি বলেন, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ইসরায়েলের দাবি অতিরঞ্জন হতে পারে। কেননা, ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের উল্লেখযোগ্যভাবে হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

এই বিশ্লেষক আরও বলেন, তবে এত এত রকেট ধ্বংসের দাবি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডার দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি হিজবুল্লাহর দীর্ঘমেয়াদি সামরিক অভিযানের সক্ষমতাকে সীমিত করে দিতে পারে।

এটা কি সর্বাত্মক যুদ্ধ

না। এটা ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ নয়।

গত ৮ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৯৭ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নিহতের সংখ্যা অন্তত ৫৬৬। এর মধ্যে ১৩৩ জন বেসামরিক মানুষ।

গত রোববার ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ৩০টি গ্রাম ও শহরে হামলা চালিয়েছে। গত অক্টোবরের পর লেবাননে এটাই ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বিমান হামলার ঘটনা।

অন্যদিকে হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, ইসরায়েলে তারা শুধু সামরিক স্থাপনা নিশানা করে হামলা চালিয়েছে। তারা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো এড়িয়েছে।

গত ৩০ জুলাই হিজবুল্লাহ কমান্ডার শোকরকে হত্যা করা হয়। মূলত তারপর থেকেই ইসরায়েল ও তার মিত্ররা হিজবুল্লাহর দিক থেকে প্রতিশোধমূলক হামলার আশঙ্কায় দিন গুনছিল।

হিজবুল্লাহ বিবৃতি দিয়ে বলেছে, শোকর হত্যার বদলা নিতেই তারা গত রোববার ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে। প্রতিশোধমূলক এই হামলার ‘প্রথম পর্যায়’ তারা সফলভাবে শেষ করেছে। হামলার প্রভাব পর্যালোচনা করে তারা পদক্ষেপ নেবে।

বৈরুতের সেন্ট জোসেফ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক করিম এমিলি বিতার আল-জাজিরাকে বলেন, এই দফার লড়াই আপাতত শেষ হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে আগামী সপ্তাহগুলোতে আর হামলার ঘটনা ঘটবে না।

হানিয়া-শোকর হত্যার বদলা?

হিজবুল্লাহ প্রকাশ্যেই বলেছে, সংগঠনের কমান্ডার শোকরকে হত্যার বদলা নিতেই তারা ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে।

শোকর হত্যার পরদিন ইরানের রাজধানী তেহরানে গুপ্ত হামলায় নিহত হন হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হামাস ও ইরান।

হানিয়া হত্যার বদলা নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে তেহরান। তবে হানিয়ার হত্যার বদলার বিষয়ে হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি।

হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন, আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে হিজবুল্লাহ।

ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর আঞ্চলিক মিত্রদের মধ্যে হামাস আছে। আছে ইরাকের ইসলামিক রেজিসট্যান্সের মতো সশস্ত্র সংগঠন।

হাসান নাসরুল্লাহ আরও বলেন, তাঁরা স্বতন্ত্রভাবে জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত বেছে নিয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব দেখতে পাওয়া যাবে।

তবে কমান্ডার শোকর হত্যাকাণ্ডের বদলা এত পরে কেন? হাসান নাসরুল্লাহর ভাষ্য, বদলার বিষয়টি নিয়ে তাঁরা মিত্রদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। এককভাবে হামলা চালানো হবে, নাকি সবাই মিলে একযোগে হামলা চালাবে—বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সময় লেগে গেছে।

হিজবুল্লাহর হামলার অন্যতম নিশানা ছিল তেল আবিবের কাছের গ্লিলোট ঘাঁটি। সেখানে ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তরের একটি ইউনিটের অবস্থান রয়েছে। হাসান নাসরুল্লাহর ভাষ্যে, এই ইউনিটটি গুপ্তহত্যার অভিযান পরিচালনা করে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এএফপিকে বলেন, এই ঘাঁটিতে হামলা হয়নি।

অধ্যাপক ইমাদ সালামি বলেন, হিজবুল্লাহ সম্প্রতি যেসব ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, তা মূলত সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ কমান্ডার শোকর হত্যার বদলা হিসেবে। হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হানিয়া হত্যার বদলার সঙ্গে এই হামলার সরাসরি যোগসূত্র নেই।

ইমাদ সালামি আরও বলেন, হিজবুল্লাহ ইঙ্গিত দিয়েছে, তাদের প্রতিশোধমূলক হামলা কোনো একক বিষয় নয়, বরং এটা বিস্তৃত কৌশলের অংশ।

যুদ্ধবিরতি আলোচনায় প্রভাব ফেলবে?

হ্যাঁ। বড় পরিসরে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় প্রভাব ফেলতে পারে।

ইমাদ সালামি বলেন, এই ঘটনাগুলো মিসরের কায়রোয় চলমান শান্তি আলোচনায় তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

গত রোববার সন্ধ্যায় হাসান নাসরুল্লাহ বলেন, এটা এখন স্পষ্ট যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আলোচনায় নতুন শর্ত দিতে যাচ্ছেন। তাই আর অপেক্ষা করার কোনো কারণ নেই।

হিজবুল্লাহ-ঘনিষ্ঠ লেবাননের রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাসেম কাসির বলেন, রোববারের হামলা ছিল হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে সংগঠনটির কমান্ডার শোকর হত্যার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। একই সঙ্গে তা কায়রোয় থাকা ফিলিস্তিনি আলোচকদের প্রতি হিজবুল্লাহর সমর্থনেরও বার্তা। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে আলোচনার ফলাফলের পাশাপাশি ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার যোগসূত্র থাকতে পারে।

এখন কী ঘটতে পারে

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে। কোনো পক্ষই চাইছে না, উত্তেজনা আরও বাড়ুক।

তাই এখন উত্তেজনা কিছুটা কমবে বলে মনে হচ্ছে।

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাল্টাপাল্টি হামলায় উভয় পক্ষের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হয় না।

অন্যদিকে দুই পক্ষ এখনো নিজ নিজ সামরিক অবস্থানে অটল থাকায় পরবর্তী সময়ে কী হয়, তা দেখার জন্য বেসামরিক নাগরিকদের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

অধ্যাপক করিম এমিলি বিতার বলেন, লেবানন অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। দেশটির বেশির ভাগ নাগরিক, এমনকি হিজবুল্লাহর বহু সমর্থকও বড় পরিসরের যুদ্ধের পক্ষে নন।

আল জাজিরা

No comments

Powered by Blogger.