ঢাকায় রিকশা নিয়ন্ত্রণে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সর্বশেষ গত মে মাসে হাসিনা সরকারের আমলে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধের কথা জানান তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে রিকশাচালকদের আন্দোলনের মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসা হয়।
এরপর থেকেই ঢাকায় রাস্তায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে থাকে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো। ঢাকায় কী পরিমাণ রিকশা রয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে বর্তমানে ঢাকায় ১২ লাখের বেশি রিকশা চলাচল করছে। এরমধ্যে শুধু দক্ষিণ সিটিতেই চলছে সাত লক্ষাধিক। যদিও এসব রিকশার বড় একটি অংশ অবৈধ। ঢাকায় দুই সিটি মিলিয়ে লাইসেন্স রয়েছে এমন রিকশার সংখ্যা ২ লাখের কিছুটা বেশি। সম্প্রতি গণপরিবহন সংকটকালীন সময় ঢাকার বাইরে থেকেও ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা ঢুকে পড়েছে রাজধানীতে। এসব রিকশাও এখন দেদারছে চলছে মূল সড়কে।
একটি প্যাডেলচালিত রিকশা বানাতে মাত্র ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। আর ব্যাটারিচালিত রিকশা বানাতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। সরকারিভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমোদন নেই। বিআরটিএ’র তথ্যানুযায়ী, গত বছর ৭ হাজার ৮৩৭টি যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে অটোরিকশা ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ ও ব্যাটারিচালিত রিকশা ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বর্তমানে ঢাকার সড়কে তীব্র বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে একইসঙ্গে যানজট বাড়ছে। এরমধ্যে মহাসড়কে রিকশা চলাচল করাকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সড়কে বের হলেই যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় রিকশা। সড়কের একপাশ জুড়ে থাকে রিকশার সারি। একটি রিকশার গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০-৩০ কিলোমিটার হয়ে থাকে। তাই রিকশার কারণে ভারী মোটরযানের গতিও শ্লথ হয়ে যায়। এতে সৃষ্টি হয় যানজটের। ভারী যানচালকরা জানিয়েছেন, মহাসড়কের জন্য রিকশা চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে-সেখানে তারা রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এতে রাস্তা সরু হয়ে মহাসড়কের গতি কমিয়ে ফেলে। জহির নামের এক রাইদা বাসচালক বলেন, মহাসড়কে রিকশা চলার কারণে গাড়ি চালাতে অসুবিধা হয়। কোনো রিকশার পেছনে গাড়ি থাকলে গতি উঠানো যায় না, ধীরে চালাতে হয়। এখন তো ঢাকার সব জায়গায় রিকশা চলছে। গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোতেও এখন রিকশা চলে। এমএম লাভলী পরিবহনের এক চালক বলেন, ফার্মগেট-কাওরান বাজার এলাকায় আগে রিকশা চলতো না। কিন্তু এখন এই সড়ক দিয়েই রিকশা চলছে। অটোরিকশাগুলো খুব জোরে চলে। এগুলোর কারণে ঝুঁকি বাড়ে। মেহেদী হাসান নামের এক মোটরসাইকেলচালক বলেন, রিকশার কোনো লুকিং গ্লাস নেই। তারা হঠাৎ হঠাৎ পিছনে না দেখে ডানে-বামে চাপে। এতে পেছনে থাকা দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগতে পারে।
জানা গেছে, একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় ব্যাটারি থাকে ৩ থেকে ৪টি। প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় দিনে ৬ থেকে ৮ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। ফলে অবৈধ এই পরিবহনে বড় পরিসরে বিদ্যুৎ খরচ হয়। এদিকে গতকাল শাহবাগে দুই ঘণ্টা বিক্ষোভ করেন প্যাডেলচালিত রিকশাচালকরা। বিক্ষোভে তারা বলেছেন, ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলার অনুমতি না থাকলেও দেদারছে চলছে এটি। প্যাডেলচালিত রিকশার বৈধতা আছে, নাম্বার আছে। এর জন্য প্রতি বছর ৩০০ টাকা ফি দিতে হয় তাদের। গত মে মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর অনুমতি দেয়ায় তা সড়কে বেপরোয়া চলাচল করছে বলেও অভিযোগ করছেন প্যাডেলচালিত রিকশাচালকরা। রিকশাচালকদের দাবি, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মতো উত্তরেও রিকশার নতুন লাইসেন্স দিতে হবে, পুরনো লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। তারা বলেছেন, সরকারের রাজস্ব বাড়ানো ও বৈধ লাইসেন্সধারী রিকশা পেশাজীবীদের স্বার্থে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে চালকদের লাইসেন্স দিতে হবে। এছাড়া অসুস্থ চালকদের জন্য ফ্রি ফ্রাইডে মেডিকেল চিকিৎসা সেবাসহ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স পাওয়া রিকশা পেশাজীবীদের ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার দাবি করেছেন চালকরা।
বর্তমানে ঢাকার আশেপাশের ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো সব ঢাকায় ঢুকেছে। এটার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এখন মূল সড়ক সব ধরনের রিকশা চলাচল দ্রুত বন্ধ করতে হবে। শাখা সড়কে চললেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা দরকার। এখন যানজট মূল সড়ক থেকে শাখা সড়কেও চলে যাচ্ছে। তাই শাখা সড়কেও ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। তাই রিকশা কোথায় পার্কিং হবে, সার্কুলেশন কীভাবে হবে এসব পরিকল্পনা লাগবে।
এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের কারখানাগুলোতে তদারকি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। মোটরগুলো আমদানি হচ্ছে এগুলো বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনকে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অতিদ্রুত একটা নীতিমালা তৈরি করা দরকার। বিগত সরকারের সময়েও এই নীতিমালার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো কাগজে-কলমে কাজ হয়, আলোর মুখ দেখে না। মূল সড়কে চলবে গণপরিবহন। আমাদের সড়কে এই ছোট ছোট যানবাহন দিয়ে চাহিদা পূরণ হবে না।
অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঢাকার সড়কে চলছে রিকশা। অলিগলি ছাপিয়ে মূল সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তিন চাকার এই যান। কিছু ভিআইপি সড়কেও চলতে দেখা যাচ্ছে রিকশা। প্যাডেল ছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়েও চালকরা মহাসড়কে উঠছেন। কোথাও কোথাও উল্টোপথেও চলছে রিকশা। শুধু ঢাকার রিকশাই নয়, ঢাকার বাইরে থেকেই বর্তমানে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ঢুকে পড়েছে রাজধানীতে। এতে সড়কের গতিরোধ, বিশৃঙ্খলা ও যানজট তৈরি হচ্ছে। এছাড়া ভারী মোটরযানের পাশাপাশি তিন চাকার এই হালকা যান চলার কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
No comments