বন্যায় বাড়ছে উদ্বেগ, উত্তেজনার পারদ চড়ছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র প্রতিনিধির একজন নাহিদ ইসলাম ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, “সতর্কতা ছাড়াই বাঁধ খুলে দিয়ে ভারত অমানবিকতা প্রদর্শন করেছে।” একটি ফেসবুক পোস্টে, তিনি লিখেছেন: “যে প্রজন্ম ভারতকে আমাদের শত্রু হিসাবে দেখে তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।” বাংলাদেশের কিংবদন্তি রাজনীতিবিদদের মধ্যে একজন, প্রয়াত মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যিনি অভিযোগ তুলেছিলেন, ভারত বাংলাদেশকে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলির পানি থেকে বঞ্চিত করছে, এটি তাঁরই একটি উদ্ধৃতি।
ভারত এবং বাংলাদেশ গঙ্গা (পদ্মা), তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) সহ ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী ভাগ করে। ইউনূস প্রশাসনের ছাত্র প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম, এমনকি একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ভারতকে “পানি সন্ত্রাস” এর দায়ে অভিযুক্ত করেছে। অন্য একটি পোস্টে নাহিদ ইসলাম লিখেছেন, “আমরা তিস্তা প্রকল্প চীনকে দিলে ভারত জব্দ হবে।” তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতার কারণে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাব গ্রহণে ভারতের সিদ্ধান্তহীনতাকে কাজে লাগাতে চাইছে চীন। নাহিদ ইসলামের মন্তব্যের ভার রয়েছে, কারণ তিনি ছাত্র বিক্ষোভের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন। যে বিক্ষোভ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকে উৎখাত করেছিল। নাহিদ বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান।
বৃহস্পতিবার, পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক একটি বিবৃতি জারি করে বন্যার কারণ ব্যাখ্যা করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রক বলেছে-'আমরা বাংলাদেশকে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখেছি যে, ত্রিপুরার গোমতী নদীর উজানে দুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় নাকি বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তের জেলাগুলিতে বন্যার বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এটি সঠিক নয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর ক্যাচমেন্ট এলাকায় গত কয়েকদিনে রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং বাংলাদেশে বন্যাটি মূলত বাঁধের নিচের দিকের এই বৃহৎ ক্যাচমেন্টের পানির কারণে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে দুম্বুর বাঁধটি বাংলাদেশের ১২০কিলোমিটার উজানে অবস্থিত এবং এটি একটি কম উচ্চতার বাঁধ, প্রায় ৩০ মিটার লম্বা। প্রবল প্রবাহের ক্ষেত্রে, পানি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্গত হয়। ভারত বিকাল ৩টা পর্যন্ত পানির স্তর বৃদ্ধির প্রবণতা সম্পর্কে বাংলাদেশকে অবহিত করতে থাকে। ২১ আগস্ট, সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বন্যার কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়। সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতের বিবৃতিতে পানি বন্টনের সহযোগিতাকে দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে যে ভারত দ্বিপাক্ষিক পরামর্শ এবং প্রযুক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে পানি সম্পদ এবং নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পারস্পরিক উদ্বেগগুলি সমাধান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সন্ধ্যায় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন। ভারতের কিছু নেতৃস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে যে ভার্মাকে তলব করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া এটিকে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলে জানিয়েছে। ঘটনার সাথে পরিচিত ঢাকার লোকেদের মতে, ভার্মা ভুল তথ্যের দ্বারা সৃষ্ট জটিলতাগুলির সমাধানে ইউনূসের সাথে দেখা করেছিলেন। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তার বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা মোতাবেক, বৈঠকে ইউনূস বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথভাবে বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি উচ্চ-পর্যায়ের কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। ইউনূস আশাপ্রকাশ করেছিলেন যে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিরোধের শীঘ্রই সমাধান করা হবে।
জটিল সমস্যা
যদিও বিবাদের সমাধান করা সহজ বিষয় নয়। কারণ একাধিক নদীর পানি নিয়ে বিরোধ রয়েছে, তবে গঙ্গা ও তিস্তা প্রধান। রাজনীতিবিদ ভাসানীর শেষ প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচী ছিল ১৯৭৬ সালের মে মাসে 'ফারাক্কা লং মার্চ'। ৯৬ বছর বয়সী ভাসানী ১৯৭৫ সালে গঙ্গা নদীর উপর ভারত যে ফারাক্কা ব্যারেজ স্থাপন করেছিল তা ভেঙে ফেলার দাবিতে ঐতিহাসিক পদযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে এই ব্যারেজ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পানির অংশ থেকে বঞ্চিত করবে। ভারত ১৯৯৬ সালে (১৯৭৭ এবং ১৯৮৮সালের মধ্যে অ্যাড-হক ব্যবস্থা অনুসরণ করে) বাংলাদেশের সাথে একটি পানি বন্টন চুক্তি সম্পন্ন করে। যার প্রেক্ষিতে ভাসানীর লং মার্চকে আজও বাংলাদেশ স্মরণ করে। গত কয়েক বছরে ফারাক্কা লং মার্চ স্মরণ দিবসের তাৎপর্য দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসে, মার্চের ৪৮ তম বছর স্মরণে ঢাকায় একাধিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। বেশিরভাগ ইভেন্টের আয়োজকরা দাবি করেছিলেন যে বাংলাদেশের ৫৪ টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ন্যায্য অংশের জন্য লড়াই করা উচিত।
এই ধরনের আবেগ গত দুই থেকে তিন বছরে বেড়েছে, কারণ বাংলাদেশ ২০১৯ সালে ভারতকে ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলনের অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছিল কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ২১শে আগস্টের বন্যার পর, ছাত্র কর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে ফারাক্কা ব্যারেজ বন্ধ করার জন্য ভাসানীর দাবির পুনরাবৃত্তি করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় রাজনীতিবিদ বলেছেন- এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অপ্রস্তুত বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভারতকে বলির পাঁঠায় পরিণত করতে চাইছে। ভারত-বাংলাদেশ পানি-বণ্টন চুক্তির ৩০ বছরের মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ২০২৬ সালে চুক্তির পুনর্নবীকরণের জন্য ভারতের সাথে আলোচনার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের নতুন সরকার অন্যান্য বিকল্পগুলিও বিবেচনা করছে।
অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকার একজন বুদ্ধিজীবী আনু মুহম্মদ ভারতকে উজানে বাঁধ দিয়ে আন্তঃসীমান্ত নদীতে পানি প্রবাহে বাধা, বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দেওয়া এবং পানি বণ্টনে একতরফা পদক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের মতে, ১৯৯৬সালের পানি-বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে ঠিকই তবে সামগ্রিকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ বাংলাদেশকে দারুণ যন্ত্রণা দিয়েছে। ওই অধ্যাপক দাবি তুলেছেন- “এটাই সময়, বাংলাদেশের উচিত ভারতের কাছে ফারাক্কা ব্যারেজ বাতিল করার দাবি জানানো। এটা অযৌক্তিক দাবি হবে না। অতীতে, ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ফারাক্কা ব্যারাজের সমালোচনা করেছিলেন এবং এটি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।"
তিস্তার পানিবণ্টন সংকট সমাধানও সহজ হবে না। ভারতের কাছে এটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় দাবি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই চুক্তির বিরোধিতা করে আসছেন এই অভিযোগ করে যে তার রাজ্য পানি থেকে বঞ্চিত হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুক্তি হলো, সিকিম জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পানিকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। তিস্তার পানি উজানের প্রবাহকে মুক্ত না করে বাংলাদেশের সাথে ভাগ করা হলে পশ্চিমবঙ্গর উত্তরাংশ শুষ্ক হয়ে যাবে। যেহেতু জলবিদ্যুৎ বাঁধগুলি সিকিমের আয়ের প্রধান উত্সগুলির মধ্যে একটি, তাই ভারত সরকারের পক্ষে সিকিমকে তিস্তাকে অবাধে প্রবাহিত করতে দিতে রাজি করানোর কাজটি সহজ হবে না।
জলবায়ু উদ্বেগ
আন্তঃসীমান্ত নদী সম্পর্কিত সমস্যাগুলির পাশাপাশি ভারতের উত্তর-পূর্বে জলবায়ু পরিবর্তন বৃষ্টির ধরণকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। ভারতের চারটি রাজ্যের নদীর পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই রাজ্যগুলি হল পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের উত্তর-পূর্বে আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়। মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে বড় বন্যা সাধারণত বাংলাদেশের নিম্নধারার এলাকাকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র, 'প্রথম আলোর' একটি কলামে, আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল ভারতের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন যে, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের ফেনী ও কুমিল্লা জেলা এবং পার্শ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে তিন দিনে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তা পুরো আগস্ট মাসের গড় বৃষ্টিপাতের সমান। এই রেকর্ড বৃষ্টির কারণে এই নজিরবিহীন বন্যা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিতে বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদদের ব্যর্থতা এবং বাঁধের গেট খোলার বিষয়ে অবগত করতে ভারতের অক্ষমতাকেও দায়ী করেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাম্প্রতিক প্রবণতা অনুসারে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খরা এবং বন্যা উভয়ের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়তে পারে। সামগ্রিক বৃষ্টিপাতের হ্রাস এবং একই সময়ে চরম বৃষ্টিপাতের ঘটনাগুলি বেড়েছে। তিস্তার গড় পানি নিষ্কাশনও ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। এটি বাংলাদেশের নিম্নধারার এলাকায় পানির প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করতে পারে। নতুন আবহাওয়ার ধরণটি নির্দেশ করে যে দীর্ঘ শুষ্ক অঞ্চলগুলি সংক্ষিপ্ত ভারী বৃষ্টিপাতেই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। যদি উত্তর-পূর্ব ভারত বন্যা ও খরার ঘটনা প্রত্যক্ষ করে, তবে বাংলাদেশের নিম্নধারার অঞ্চলগুলিকে এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
সূত্রঃ দ্য ডিপ্লোম্যাট
No comments