দীপু মনির ঘুষের সাম্রাজ্য by পিয়াস সরকার
দীপু মনি বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী। ২০০৮ সাল থেকে তিনি চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। এরপর গ্রেপ্তারের পর দু’দফা রিমান্ডে নেয়া হয় তাকে। আইনত নোট-গাইড বিক্রি বন্ধ ছিল। কিন্তু আইনের ফাঁক গলিয়ে সহযোগী বই হিসেবে প্রচলিত ছিল গাইড বই। নোট-গাইডের বিপক্ষে ব্যাপক কথা বললেও তিনি নিজেই বখরা নিতেন এসব সংগঠন থেকে। এই সংগঠনের এক নেতা বলেন, আমাদের বাৎসরিক চুক্তি ছিল ১০০ কোটি টাকা। বছরে চারবার ২৫ কোটি করে দিতে হতো। এ ছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষের দিনেও পাঠাতে হতো টাকা।
টাকা তিনি শুধু যে গাইড বই প্রকাশনী থেকে নিতেন তা নয়। ঘুষ নিতেন কোচিং সেন্টারগুলো থেকেও। এই প্রতিষ্ঠানগুলোও আইনত বৈধ নয়। কিন্তু স্যাডো এডুকেশনের আওতায় চলতো এসব প্রতিষ্ঠান। এসব থেকে চাঁদার পরিমাণ নির্দিষ্ট না থাকলেও বছরে কয়েক কোটি করে টাকা নিতেন। ফার্মগেটের একটি কোচিং সেন্টারের মালিক বলেন, আমাদের ব্যবসাটা একটু অন্য রকম। আমরা বৈধ আবার বৈধ না। এজন্য সংগঠনের মাধ্যমে একটি চাঁদা তোলা হতো। সময় ভেদে নিরূপণ করে এই টাকা উত্তোলন করা হতো। ভার্সিটি ভর্তি কোচিংয়ের সময় দিতে হতো প্রায় কোটি টাকা। অন্য সময় দিতে হতো অর্ধ কোটি টাকা। এসব টাকা একত্র করে দেয়া হতো শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে। তবে তিনি টাকা নিজে গ্রহণ করতেন না। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো দীপু মনির ঘনিষ্ঠ লোকরা।
শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছেন ডা. দীপু মনি। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি) নিয়োগও দিয়েছেন নিজের পছন্দ মাফিক লোকজন। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাধ্যতামূলক পাঁচ শতাংশ যেতো তার পকেটে। এ ছাড়াও প্রকল্প ভেদে এই অর্থের হেরফের হতো। আওয়ামী লীগের আমলে বিশেষ করে ডা. দীপু মনির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। কয়েক বছর ধরে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই চলে আসলেও তার আমলে তিনি দিতে ব্যর্থ হন। বরাবরই বইয়ের পাণ্ডুলিপির কারণে এই দেরি হতো। এই দায়িত্ব জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থাকলেও ডা. দীপু মনি নিজে পড়ে দেখার জন্য নিতেন এবং দীর্ঘদিন নিজের কাছে আটকে রাখতেন। এর জন্য বরাবরই বই ছাপাতে দেরি হতো। প্রতি বছর প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানো হতো। অজানা এক কারণে বারংবার একই চক্র পেতো বই ছাপানোর কাজ। কাজগুলো বাগিয়ে নিতো সেগুলো একই মালিকের প্রতিষ্ঠান। দুটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে অস্বাভাবিক কাজ দেয়া, নির্ধারিত সময়ে বই না দেয়ার পরও জরিমানা হতো না। সক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কাজ দেয়া হতো অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস এবং কচুয়া প্রেসকে। যারা ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বই ছাপানোর কাজ বাগিয়ে নেয়। এমনকি এই দুটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের বই সরবরাহ করে। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৪ থেকে ৫ মাস দেরিতে বই দেয়ার পরও এনসিটিবি সফটওয়্যার জালিয়াতির মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের বই ডিসেম্বরে ডেলিভারি দেখানো হয়েছে। পুরো জালিয়াতির সঙ্গে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান-উৎপাদন নিয়ন্ত্রক জড়িত ছিল। এমনকি সেই সময়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অভিযোগ জানালেও নেয়া হয়নি ব্যবস্থা। আবার বিনামূল্যে বই ছাপার কাগজ কেনায় বড় ধরনের দুর্নীতি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একটি চক্র। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত কাগজ বাজারদরের চেয়ে গড়ে টনপ্রতি ২০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে কেনা হয়েছে। বাড়তি দামে কেনা হয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ আর্টকার্ডও। ফলে সরকারের গচ্চা গেছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
বিশেষ করে নতুন কারিকুলাম নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় তাকে নিয়ে। করোনাকালীন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ৫৪৪ দিন বন্ধ থাকার পর খোলা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ এই সময় বন্ধ থাকার কারণে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েন। করোনার কারণে স্থগিত হয় ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষা। এই শিক্ষার্থীদের অটোপাস দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছিল। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন ও দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে গঠন করা হয়েছিল এনটিআরসিএ। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছিল দুর্নীতির আখড়া। গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশে কালক্ষেপণ, ভুয়া সনদ, আলাদা আবেদন নিয়ে কোটি কোটি টাকা আদায় ছিল এই প্রতিষ্ঠানের কাজ। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে একাধিকবার আবেদন জানিয়েও লাভ হয়নি চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের। এমনকি এনটিআরসিএ হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। এনটিআরসিএ থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়াসহ সমস্যা নিরসনে উদ্যোগ না নিয়ে বরং জিইয়ে রেখেছিলেন। নতুন কারিকুলাম চালু করা হয় ২০২৩ সালে। এই পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছিল শুরু থেকেই। এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দিতেন না। কারিকুলাম নিয়ে সমালোচনা করায় সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতজনের নাম উল্লেখ করে ৫৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। যাদের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি করায় অনেক অভিভাবক পালিয়ে থাকতেও বাধ্য হন। আবার চাকরি হারানোর ভয়ে অনেক শিক্ষক চুপ থাকতে বাধ্য হন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একক আধিপত্য বিস্তারে কাজ করছিলেন ডা. দীপু মনি। কুক্ষিগত করেছিলেন পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ড পরিবর্তন করে দখল নেন। এ ছাড়া অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে দখল করেন মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান করা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামকে। তার সঙ্গে আরও ১৩ জন রয়েছেন। জামায়াত সমর্থিত হিসেবে পরিচিতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর মো. আবদুল্লাহ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান। তিনিও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও দখল নেন। অভিযোগ রয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির সঙ্গে জড়িত থাকায় দেননি সমাবর্তনের অনুমতি। ২০১২ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও ২০২৩ সালে এসে প্রথম সমাবর্তনের অনুমতি পায়। এরপর তিনি এতে যোগ দেননি।
এসব ঘুষ-দুর্নীতির পরিচালনা করা হতো ভাই জেআর ওয়াদুদ টিপু ও চাঁদপুর পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদারের মাধ্যমে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করে রতন কুমার মজুমদারকে একাধিকবার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেন। এই দু’জন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য দেখতেন। এমনকি ঢাকার কলাবাগানে ছিল দীপু মনির অঘোষিত লিয়াজোঁ দপ্তর। আর বনানীতে ছিল ‘রাজনৈতিক স্বজন’ ভবন। তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের রেট ছিল এক থেকে তিন কোটি এবং অধ্যক্ষ নিয়োগ হতো ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকায়। বদলির রেট ছিল পদভেদে ২ থেকে ৩০ লাখ টাকা। এই সময়ে নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে স্বায়ত্তশাসিত চার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগে লেনদেন হয়েছে।
নিজ জেলায় চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শুধু জমি অধিগ্রহণে ৩৫৯ কোটি টাকা দুর্নীতির পাঁয়তারা করেন দীপু মনি। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগেই সেখানকার সাড়ে ৬২ একর জমি মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নেন তার আত্মীয়রা। এমন একাধিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিস। এর প্রতিবাদ জানানোর কারণে ৪৮ ঘণ্টা পর তাকে নেত্রকোনায় বদলি করা হয়। চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনায় বালু উত্তোলন করতেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচিত লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সেলিম খান এই বালুর ব্যবসা দেখতেন। তিনি এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বালু তোলার সমালোচনা করায় পদ হারান। দীপু মনির নির্বাচনী এলাকা হাইমচর-নীলকমল ইউনিয়নের বাহেরচরে বিপুল পরিমাণ খাসজমি নিজের কব্জায় নিয়ে দীপু মনির ভাই গড়ে তোলেন ‘টিপু নগর’। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দুর্বৃত্তদের হামলায় প্রাণ হারান সেলিম।
এদিকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ৪১ জন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির এই তালিকায় রয়েছে ডা. দীপু মনিরও নাম।
No comments