লোহার খাঁচায় আসামি রাখা ‘অমানবিক’ by আসাদুজ্জামান

গ্রেপ্তারের পর কাউকে আদালতে তোলা হলে নেওয়া হয় এজলাস কক্ষের এক পাশে থাকা একটি লোহার খাঁচার মধ্যে। আবার কোনো মামলার আসামি হয়ে কেউ হাজিরা দিতে গেলে তাঁকেও ঢুকতে হয় ওই খাঁচার মধ্যে। তবে ওই ব্যক্তি আসলেই দোষী নাকি নির্দোষ, তখনো তা প্রমাণিত হয়নি। এই বিষয় সামনে এনে মানবাধিকারকর্মী ও আইনজ্ঞরা বলছেন, এজলাস কক্ষে এভাবে আসামিকে লোহার খাঁচার মধ্যে ঢোকানো অমানবিক ও সংবিধান–পরিপন্থী। এই ব্যবস্থা আর থাকা উচিত নয়।

এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রথম আলোকে বলেন, একটি সভ্য রাষ্ট্রের আদালতে লোহার খাঁচা থাকতে পারে না। আগে কখনো লোহার খাঁচা ছিল না। কয়েক বছর ধরে লোহার খাঁচা বসানো হয়েছে। অবিলম্বে আদালত থেকে লোহার খাঁচা তুলে নেওয়ার দাবি জানান এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

আদালতে লোহার খাঁচায় আসামি রাখাকে সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারের মুখোমুখি কোনো আসামির সঙ্গে সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের চেতনার পরিপন্থী কোনো আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়। একজন আসামিকে লোহার খাঁচায় ঢোকানো কিংবা ঢুকতে বাধ্য করা অমানবিক। এটি সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী।’

সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার–সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদের (ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস–আইসিসিপিআর) ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কাউকে নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি দেওয়া যাবে না। আইসিসিপিআরের অনুচ্ছেদ ১৪(২) অনুযায়ী, ফৌজদারি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত প্রত্যেকের আইন অনুযায়ী দোষী প্রমাণের আগপর্যন্ত নির্দোষ বলে গণ্য হওয়ার অধিকার থাকবে।    

বিচারিক আদালতের এজলাস কক্ষ থেকে লোহার খাঁচা অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে ১০ আইনজীবী গত ২৩ জানুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। দেশের কোন কোন আদালতের ভেতরে (অধস্তন আদালতের এজলাস কক্ষ) লোহার খাঁচা রয়েছে, তা জানতে চান হাইকোর্ট।

রিটকারী আইনজীবী শিশির মনির বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে দেশের কোন কোন বিচারিক আদালতে লোহার খাঁচা রয়েছে, সেই তথ্য জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তাঁর জানামতে, লোহার খাঁচা থাকার তথ্য হাইকোর্টে জমা দেওয়া হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসও আদালতের এই লোহার খাঁচা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছিল। ওই সব মামলায় হাজিরা দিতে তাঁকে বহুবার আদালতে যেতে হয়েছে। গত ১২ জুন পুরান ঢাকার একটি আদালতে হাজিরা দেওয়ার পর আদালত চত্বরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘আজকে আমরা অনেকক্ষণ খাঁচার (আসামির কাঠগড়া) মধ্যে ছিলাম। বলা হয়েছিল, আপনি থাকেন। কিন্তু আমরা সারাক্ষণ লোহার খাঁচার মধ্যে ছিলাম। আমি আগেও প্রশ্ন তুলেছি, এটা ন্যায্য হলো কি না? আমি যত দূর জানি, যত দিন আসামি অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছে, তত দিন তিনি নিরপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবেন।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেছিলেন, ‘একজন নিরপরাধ নাগরিককে লোহার খাঁচার (আসামির কাঠগড়া) মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে শুনানির সময়, এটা আমার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক। এটা গর্হিত কাজ। এটা কারও ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না হয়। একটা পর্যালোচনা হোক। একটা সভ্য দেশে কেন একজন নাগরিককে পশুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে শুনানির সময়, যেখানে একজন নাগরিক দোষী সাব্যস্ত হননি। অনেক আইনজ্ঞ আছেন, বিচারপক্ষের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা পর্যালোচনা করে দেখবেন, এটা রাখার দরকার আছে কি নেই। সারা সভ্য দুনিয়ায় যেভাবে হচ্ছে, সেভাবে হবে। আমরা সভ্য দেশের তালিকায় থাকতে পারি। লোহার খাঁচা মানবতার প্রতি অপমান। কেন পশুর মতো একজন মানুষকে খাঁচার ভেতর ভরে রাখবে? এটা সরিয়ে ফেলা উচিত।’
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে গত বুধবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। তখনো তাঁদেরকে এজলাস কক্ষে থাকা লোহার খাঁচার ভেতর ঢোকানো হয়েছিল।

কী করা উচিত

সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবী জানিয়েছেন, একটা সময় পৃথিবীর অনেক দেশেই ফৌজদারি মামলার আসামিদের আদালতকক্ষের লোহার খাঁচায় রাখা হতো। তবে আইসিসিপিআরের চেতনার পরিপন্থী হওয়ায় অনেক দেশই লোহার খাঁচায় আসামি রাখার পদ্ধতিতে থেকে সরে এসেছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ কিংবা আমেরিকার ফৌজদারি আদালতে লোহার খাঁচায় আসামি রাখা হয় না।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতগুলোয় আসামি রাখা হতো কাঠের তৈরি কাঠগড়ায়। সংবিধান অনুযায়ী, বিচারের মুখোমুখি কোনো আসামির সঙ্গে নিষ্ঠুর কিংবা অমানবিক আচরণ করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কোনো আসামিকে লোহার খাঁচায় রাখা অমানবিক বিষয়।

লোহার খাঁচায় আসামি রাখার পদ্ধতি তুলে দিয়ে আগের মতো কাঠগড়ায় তাঁদের রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক। সদ্য অবসরে যাওয়া জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ সাইফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর কোনো সভ্য রাষ্ট্রের আদালতের ভেতর লোহার খাঁচা নেই। অবিলম্বে আদালত থেকে লোহার খাঁচা তুলে নেওয়ার মত দেন তিনি।

লোহার খাঁচা রাখার আগে যেভাবে আসামিদের কাঠগড়ায় রাখা হতো কিংবা আসামিরা যেভাবে এজলাস কক্ষে অবস্থান করতেন, সেটি পুনরায় চালু করা উচিত বলে মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ।

No comments

Powered by Blogger.