গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী যেমন বাংলাদেশ চাই by শহীদুল্লাহ ফরায়জী
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্র যে সবার এই দর্শনটুকু গ্রহণ করার নৈতিকশক্তি ছিল না। রাষ্ট্রের সবাই যে ‘নাগরিক’- এই শাশ্বত সত্যকে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারেনি। রাষ্ট্র সম্পর্কে উচ্চতর ধারণা আওয়ামী লীগের একেবারেই নেই। ফলে নাগরিক হত্যা হলেই তাকে বিএনপি-জামায়াত হিসেবে চিহ্নিত করে হত্যার বৈধতা নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতো। রাষ্ট্রের নাগরিককে নাগরিক না দেখে তার রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতো। সুতরাং শত্রুকে বল প্রয়োগ করে হত্যা করা বা গ্রেপ্তার করা কিংবা নির্যাতন করে প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করা সরকার কর্তব্য মনে করতো। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের নন্দিত নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। একদলীয় বাকশালের ক্ষতচিহ্ন মুছে দেয়ার প্রশ্নে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের আন্দোলনই ছিল শেখ হাসিনার একমাত্র বিকল্প।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, কোনোক্রমে দলীয় সরকারের অধীনে নয়, এই নৈতিক অবস্থান এবং আন্দোলন-সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায় সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। একটা সময়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে শেখ হাসিনা উপলব্ধি করলো যে, কোনো অবাধ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করতে পারবে না, বিএনপি এবং অন্যান্য শক্তি নির্বাচন করলে তার ........ভরাডুবি নিশ্চিত।
সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করার উদ্যোগে যুক্ত করে বিচারপতি খায়রুল হককে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা তৃষ্ণার কারণে জনগণকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং রাষ্ট্র আর জনগণের মধ্যে যে সামাজিক চুক্তি তা অস্বীকার করে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করে। নাগরিকদের উপর শুধুমাত্র দমন-পীড়ন ও হিংস্রতা বা বর্বরতা প্রয়োগ করাকেই জরুরি কর্তব্য মনে করে। সংবিধানকে হাতের খেলনায় পরিণত করে ফেলে। বিচার বিভাগ দলীয় অঙ্গসংগঠনের রূপ লাভ করে। নির্বাহী বিভাগের চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি এবং বিরোধী মত-পথের আন্দোলন স্তব্ধ করার বেআইনি পদক্ষেপকে বিচার বিভাগ বাধাগ্রস্ত করেনি বরং বিরোধী দলের নিরপরাধ নেতাকর্মীদের দণ্ড প্রদান করেছে, রিমান্ড মনজুর করেছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রভাব ও প্রতিপত্তি ব্যবহার করে ব্যাপক সম্পদের মালিকানা অর্জন করে স্বৈরাচারী সরকার ও সহযোগীগণ। ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে দাস বা ক্রীতদাসে পরিণত করে। জনগণকে না দিতে পেরেছে খাবার, না দিতে পেরেছে অধিকার।
স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গত ১৫ বছর ধরে অব্যাহত লড়াই-সংগ্রামের এই পর্যায়ে এসে যুক্ত হয় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। এটা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, অবিস্মরণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা। স্বৈরাচারী আর স্বেচ্ছাচারী শাসনের ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট ও নিষ্পেষণের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের দাবিতে রাজপথ দখল করে। ছাত্ররা বুকের তাজা রক্ত উপহার দিয়ে রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তিকে প্রতিরোধ করে। আবার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সমগ্র জনগণকে গণবিদ্রোহে শামিল হতে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং গণবিস্ফোরণ, গণঅভ্যুত্থান ও গণ-বিদ্রোহের মূলশক্তি বা কেন্দ্রবিন্দুতে ছাত্রসমাজের অবস্থান নিশ্চিত হয়। ছাত্র, নারী শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনী-সহ সর্বস্তরের জনতার এক বিপ্লবী শক্তি আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বাংলাদেশের সমস্ত ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। হয় মৃত্যু, নয় মুক্তি- এই প্রতিশ্রুতিকে গ্রহণ করে দু’হাত পেতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করায় অত্যাচারের দুর্গ ধীরে-ধীরে ভাঙতে শুরু করে। ছাত্রদের এই অপরিসীম আত্মত্যাগ এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের চেতনা সমগ্র জাতিকে আলোকিত করায় প্রশাসন বিচলিত হয়ে পড়ে, দেশপ্রেমিক ‘সেনাবাহিনী’ ছাত্র-জনতার ওপর বল প্রয়োগের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকায় গণঅভ্যুত্থান দ্রুত চূড়ান্তরূপ লাভ করে। দেশের সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর এখনো ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়নি, এখনো নিপীড়নকারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য অপসারিত হয়নি কিন্তু এই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ভিত্তি তৈরি করেছে। যেহেতু এটি গণঅভ্যুত্থান, কোনোক্রমেই বিপ্লব নয়, সেহেতু সমাজ রূপান্তরের প্রশ্নটি হবে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন। সুতরাং সমাজতন্ত্রে প্রবর্তন বা বৈপ্লবিক ধারায় কমিউন রাষ্ট্রের প্রবর্তনও নয় বরং আমাদের আশু কর্তব্য হবে ঔপনিবেশিক নিপীড়নকারী শাসন ব্যবস্থার অবসানে প্রয়োজনীয় আইন ও শাসন কাঠামোর সংস্কার করা। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে আকাঙ্ক্ষা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে, সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়েই নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে হাজির করতে হবে। ঔপনিবেশিক মন-মানসিকতা বা উন্মত্ততা থেকে নিজেদের মুক্ত করা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্নে খুব জরুরি কাজ। সমস্ত জনগণের মালিকানা, অধিকার, গণতন্ত্র অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। সংবিধান ও ক্ষমতা কাঠামোর কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশোধন, পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজন বা সংস্কার করতে হবে তা চিহ্নিত করতে হবে। গণবিরোধী আইন ও বিধি-বিধান বাতিল করতে হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অসঙ্গতি দূর করতে হবে। এই অসঙ্গতি দ্রুত দূর করার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের দমনাত্মক ভূমিকার অবসান ঘটানো। গণঅভ্যুত্থানকারী শক্তি যেহেতু বঞ্চনা, বৈষম্য, নিপীড়নের অবসান ঘটাতে চায়, সেহেতু গণমানুষের বিরোধী শক্তিগুলোকেও পর্যুদস্ত করতে হবে।
প্রথমত, ফ্যাসিবাদের সহযোগীদের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ থেকে অপসারণ করা, অন্যায়-অবিচার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা। প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ হবে যারা রক্তপাত ঘটিয়েছে, গণহত্যা সংঘটিত করেছে এবং যারা ফ্যাসিবাদ কায়েমে ভূমিকা রেখেছে বা ইন্ধন যুগিয়েছে, তাদের ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে রেখে আইনের আওতায় আনা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবসায়িক সংগঠন, পেশাজীবী-সামাজিক সংগঠনসমূহের নেতৃত্ব থেকে ফ্যাসিবাদের উত্তরাধিকারদের ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজটি হবে, যে পরাক্রমশীল অচিন্তনীয় গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার অবসানে ন্যূনতম একটি রূপরেখা হাজির করা। গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে এগুলোকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিবেচনা করে একটি ঐকমত্যের ভিত্তিতে রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে, ফ্যাসিবাদের বিকল্প রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। মনন, চিন্তা এবং সংস্কৃতি স্তরেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
গণতান্ত্রিক সমাজ রূপান্তরে গণঅভ্যুত্থানের যারা নিয়ামক শক্তি তাদের ভূমিকা কী হবে? এই তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটটির গুরুত্ব, উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানে প্রাথমিক বিজয় লাভ করতে কতজন আত্মদান করেছে, কতজন অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছে এবং কতজন আহত অবস্থায় মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থানে আছে তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে জীবন-যৌবনকে তুচ্ছ করে যারা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করতে হবে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এমন বাংলাদেশ চাই- যেখানে চাবুক থাকবে না, চাবুক মারার মানুষও থাকবে না। প্রভু থাকবে না, কৃতদাসও থাকবে না। কেউ গৃহহীন থাকবে না, কারও রাজপ্রাসাদও থাকবে না। নিরস্ত্র মানুষকে সশস্ত্র শক্তি হত্যা করবে না, অধিকারকে বল প্রয়োগে স্তব্ধও করবে না। সকল মানুষকে নিরাপত্তা দেবে, মৃত্যুর ত্রাস সৃষ্টি করবে না। রাষ্ট্রের উপর জনগণের মালিকানা স্বীকার করবে কিন্তু উপেক্ষা করবে না। মানবিক মর্যাদার সুরক্ষা দেবে, বিনষ্ট করবে না। ন্যায়বিচারকে নিশ্চিত করবে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে না। রাষ্ট্র মিথ্যা উৎপাদনের কারখানা হবে না, রাষ্ট্র খুন করে লাশের উপর দাঁড়িয়ে শোকসভাও করবে না। অপরাধীকে ফুলের তোড়া দেবে আর নিরপরাধীকে হত্যা করবে রাষ্ট্রের এমন বৈশিষ্ট্য হতে পারবে না। মোদ্দাকথা এমন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হবে যেখানে প্রতিটি নাগরিক সুযোগ পাবে স্বাধীনভাবে নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতার বিকাশ ঘটাবার। বেঁচে থাকার অধিকার যেন রাষ্ট্র ব্যবস্থা কেড়ে না নিতে পারে। আমরা আর আবু সাঈদ, মুগ্ধ, রিয়া বা ফাইয়াজদেরকে হারাতে চাই না। নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যার বাংলাদেশ চাই না।
বাংলাদেশকে নিয়ে আবার আমরা স্বপ্ন রচনা করতে চাই, দুঃস্বপ্ন দেখতে চাই না।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
faraiæees@gmail.com
No comments