’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে ৭১ পাঠ by রফিকুজ্জামান রুমান
এই গণজাগরণ এবং তার অনিবার্য ফলাফল বাংলাদেশের ইতিহাসই শুধু পাল্টায়নি; পাল্টে দিয়েছে আমাদের কথা বলার ধরন, চিন্তা করার চ্যানেল, প্রকাশের প্রক্রিয়া, কর্মপরিধি এবং সর্বোপরি জীবনযাপনের পদ্ধতি। এটি দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়, ২০২৪-এর ৫ই আগস্টে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ এমনকি ৪ঠা আগস্টের বাংলাদেশ থেকেও ভিন্ন। এ এক নতুন বাংলাদেশ। কোটা সংস্কারের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিণত হলো নতুন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রজ্জ্বলিত প্রত্যয়ে। এবং তাই এখনো রাজপথ ছাড়েনি ক্লান্তি-অবসাদ-আত্মতৃপ্তির নাগালের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরা। বিজয় উদ্যাপনের চাইতে বিজয়কে ধরে রাখা এবং তাকে অর্থবহ করার দিক থেকে তাদের মনোযোগ সরানো যায়নি। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের অংশ হয়েছে যৌক্তিক কারণেই। তারা পুলিশের অনুপস্থিতিতে ট্র্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার জন্য দিনের পর দিন সকাল-সন্ধ্যা রাস্তায় কাটিয়ে দিচ্ছে।
শহরের দেয়ালে দেয়ালে, সড়ক-বিভাজকের গায়ে আল্পনা আঁকছে যার মধ্যদিয়ে ফুটে উঠছে অনিবার্য বিপ্লবের অপরাজেয় ইশতেহার। পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতার’ অচল ন্যারেটিভের বিপরীতে তারা হাজির করছে সম্প্রীতি সমাবেশ। হাতের রং-তুলি ফেলে তারা ছুটে যায় সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় ‘ফুল-কোর্টের’ ষড়যন্ত্র ঠেকাতে। উপদেষ্টার অযাচিত কথার জবাব দিতে শহীদ মিনারে তারা উপস্থিত হয়ে যায় বাঁধভাঙ্গা স্রোতের গতিতে। গণহত্যার ঘৃণীত অপরাধীর শাস্তির দাবিতে উত্তাল গণজোয়ার শাহবাগ থেকে ছুটে যায় ধানমণ্ডি ৩২-এ। এই বাংলাদেশ কে কবে দেখেছে!
এই প্রজন্ম যেমন ’২৪-এর গণজাগরণ তৈরি করেছে, সমান্তরালভাবে এই গণজাগরণ জেনারেশন-জেডকে তথা পুরো বাংলাদেশকে অনেক মিথ থেকে বের হওয়ার উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে। গণমানুষের সম্মিলিত শক্তির কাছে কোনো স্বৈরশাসক যে অপরাজেয় নয়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে এই গণজাগরণ। ক’দিন আগেও “শেখ হাসিনা পালায় না” বলে যে আস্ফালন উচ্চারিত হয়েছে গণভবনের ইথারে, ৫ই আগস্ট ৪৫ মিনিটের প্রস্তুতিতে সমস্ত অহংকারের কাগুজে নৌকাকে গণভবনের লেকে ভাসিয়ে দিয়ে তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। অহংকার, আস্ফালন আর ঔদ্ধত্যের যে অবর্ণনীয় পতন, তার এক অবিশ্বাস্য চিত্রনাট্য প্রদর্শিত হয়েছে সেদিনের পড়ন্ত দুপুরে গণভবনে আগত জনতার মুক্তির উৎসবের মধ্যদিয়ে। আগের দিনও সংসদের করিডোরে দাঁড়িয়ে যে মোহাম্মদ এ আরাফাত হুংকার ছুড়েছিলেন ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্যে, যার মুখের প্রতিটি কথায়, দেহের প্রতিটি ভঙ্গিতে অনিয়ন্ত্রিত অহংকারের অনুবাদ, সেই আরাফাত আজ পলাতক! পালাতে গিয়ে বিমানবন্দরে ধরা পড়া জুনাইদ আহমেদ পলকের কী অসহায় আত্মসমর্পণ! যে ক্ষমতা এমন অসহায় করে দেয়, সে কি আদৌ ক্ষমতা? পরম প্রতাপশালী সালমান এফ রহমানের সদরঘাটের নৌকায় ধরা পড়ার যে চিত্র, তা কি কখনো আপনার কল্পনায়ও ছিল? আনিসুল হক- পরিপাটি ভদ্রচেহারার মানুষ। ক্ষমতার মোহ আর বিসর্জিত বিবেক এমন নর্দমায় নামিয়েছে যেখান থেকে নৌকাও তাকে উদ্ধার করতে পারলো না! বুধবার আদালতে তাদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। যে আনিসুল হকদের মুখের কথা-ই আইন, হাতের ইশারা-ই রায়, তারা একজন আইনজীবীও পেলেন না তাদের পক্ষে শুনানি করার জন্য! কী পরিমাণ ঘৃণা আর ক্ষোভের বৃত্তে বন্দি ছিল তাদের ক্ষমতা-কাঠামো! এই দুই প্রতাপশালীর লুঙ্গি পরা, হাতে রশি বাঁধা ছবি অনেক মিথ ভেঙে দিয়েছে।
জনগণের ভালোবাসা আর সমর্থনের অভাবকে অন্য কোনোকিছু দিয়েই প্রতিস্থাপন করা যায় না। সাময়িক সময়ের জন্য তাদেরকে চেপে রাখা যায়; এই সময় যত দীর্ঘ হয়, তাদের মাঝে ঘনীভূত হওয়া ক্ষোভ ক্ষমতালোভীদের পরাজয়কে তত মর্মান্তিক করে।
সবচেয়ে বড় যে মিথ এই আন্দোলনে বেশি খোলাসা হয়েছে, তা হলো ‘তৈরি করা সত্য’ আর ‘ক্ষমতার বয়ানে নির্মিত ন্যারেটিভ’ বিনা প্রশ্নে ছেড়ে দেয়া যায় না। ‘সত্য’ আর ‘তৈরি করা সত্য’র মধ্যে বিরাজমান যোজন যোজন দূরত্ব এই প্রথম এই প্রজন্ম চিহ্নিত করতে পেরেছে। মূলত এই আন্দোলনে এই উপলব্ধিই মূল চালিকাশক্তি। তারা ক্ষমতার বলয় থেকে আগত প্রত্যেকটি ‘তৈরি করা সত্য’কে চ্যালেঞ্জ করেছে। চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করা বাস্তবতার বাটখারায় মেপে দেখেছে ক্ষমতা-কাঠামো থেকে দাঁড় করানো মিথ্যা ন্যারেটিভ। এবং শেষ পর্যন্ত তারা দেখতে পেয়েছে- এই দেশের গোটা শাসনব্যবস্থাই মিথ্যার উপর দাঁড়ানো। তাই সেটি আর কোটা সংস্কারের ছোট্ট পরিসরে থাকেনি; আন্দোলন তখন অভীষ্ট হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের উপলক্ষে।
কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক। ১৫/১৬ই জুলাই শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে যে ঐতিহাসিক ভুল করেছেন, দু’দিন পরেই তিনি সেটি অস্বীকার করলেন! সমস্ত মিডিয়ার সামনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে এভাবে সত্যকে অস্বীকার করা শিক্ষার্থীদের নতুন করে ভাবায়। সেই রাতেই তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এরপরে আন্দোলন যত তীব্র হয়, ক্ষমতা-ভবন থেকে একে একে বের হতে থাকে বাস্তবতা-বিবর্জিত সমস্ত বয়ান। দুর্দান্ত প্রতাপশালী মন্ত্রীরা, পুলিশের কর্মকর্তারা, ডিবি’র হারুনরা এমন ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে থাকে রাজপথের চিত্র যার সম্পূর্ণ বিপরীত। একটা পর্যায়ে আদালতের রায়ে যখন কোটা সংস্কার হলো, তার আগেই সারা দেশ শিক্ষার্থী-জনতার রক্তে প্লাবিত হওয়ায় বিচারের দাবিই হয়ে উঠলো মুখ্য। তখনই আন্দোলনকে দমন করার জন্য ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে বন্দি করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, তারাই নিরাপত্তা চেয়েছিল। তাই তাদেরকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এরপরে চাপের মুখে সমন্বয়কারীদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হলো। ডিবি প্রধান হারুন জানালেন, আন্দোলন বাতিলের ঘোষণা সমন্বয়কারীরা নিজেদের থেকেই দিয়েছে। কোনো চাপ ছিল না। পরবর্তীতে মুক্ত হয়ে সমন্বয়কারীরা জানালেন, তারা নিরাপত্তা হেফাজত চাননি। আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা জোর করে পড়ানো হয়েছে। তার মানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ডিবি হারুন- দু’জনেই মিথ্যা কথা বলেছেন। ছাত্র-জনতার জাগ্রত বিবেক, চোখের সামনের রক্তাক্ত রাজপথ, শহীদদের আত্মনিবেদনের উজ্জ্বল উদাহরণের সামনে এই মিথ্যা টেকেনি।
আইসিটি’র পলক নজিরবিহীনভাবে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ বিষয়ে যে কারণ দেখিয়েছিলেন, তাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। মোহাম্মদ এ আরাফাত দেশি-বিদেশি মিডিয়ার কাছে যা বলেছেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভেরিফিকেশন সেগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল এদেশের রাজপথ। সেখানে যা কিছু ঘটছে, সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে তা মিলছে না। তারা যা কিছু দেখছে, অধিকাংশ মিডিয়ায় তা দেখানো হচ্ছে না। তৈরি হয়ে গেল ফ্যাক্ট এবং ফিকশন ডিসকোর্স। ২০২৪ সালে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা যদি এভাবে ক্ষমতার হাতুড়ি দিয়ে বিকৃত করার চেষ্টা করা যায়, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের আবরণে তৈরি ন্যারেটিভের কতোটুকু ফ্যাক্ট আর কতোটুকু ফিকশন- সেই প্রশ্ন এখন জেনারেশন-জেড এর চোখে-মুখে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার রেসিপির মধ্যে কতো চিমটি ফ্যাক্ট আর কতো চিমটি ফিকশন- নতুন করে এই প্রশ্নের অনুসন্ধানকে অপরিহার্য করে তুলেছে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান।
৫৩ বছর আগের ইতিহাস, মনে করবার কারণ নেই, কোরআন-হাদিসের মতো অকাট্য, প্রশ্নহীন। বিশেষ করে বিগত টানা ১৬ বছরের আওয়ামী শাসনে ইতিহাসের যে রাজনৈতিক বিকৃতি সাধিত হয়েছে, তার বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান জরুরি। এই প্রজন্ম, যারা অভাবনীয় একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তাদের এই দিকে মনোযোগী হতে হবে। প্রশ্ন করতে হবে। ফ্যাক্ট ও ফিকশনকে আলাদা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দলীয় ডেফিনেশন ছুড়ে ফেলে মানবিক বাংলাদেশের পথে হাঁটতে হবে। নাটকে, সিনেমায়, সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের যে খণ্ডিত, বিকৃত, একপেশে বয়ান হাজির করা হয়েছে, তার কতোটুকু মিথ আর কল্পনা তা খুঁজে বের করতে হবে।
’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান যদি ব্যর্থ হতো, বুক চিতিয়ে জীবন বিলিয়ে দেয়ার অকুতোভয় মহান শহীদ আবু সাঈদকে ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে কীভাবে চিত্রায়িত করা হতো? সন্ত্রাসী? রাষ্ট্রদ্রোহী? জঙ্গি? আওয়ামী লীগ এই বাংলাদেশে যে পরিমাণ ঘৃণার জন্ম দিয়েছে, যেভাবে বিভেদের রাজনীতি করেছে, তাদের নির্মিত ইতিহাস যে সত্যি নয়, এই অভ্যুত্থান সেই বার্তাই দিয়ে গেল।
লেখক: শিক্ষক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
No comments