দ্বিখণ্ডিত করে কাশ্মিরে শান্তি আনতে পারবে ভারত?

পাকিস্তানের সঙ্গে দুটি যুদ্ধ এবং তিন দশকের সশস্ত্র বিদ্রোহের পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু-কাশ্মির ‘ইস্যু’ বন্ধ করে দিতে চায় বিজেপি সরকার। কিন্তু ‘বিভাজন ও শাসন’ এবং ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ নীতি ভূস্বর্গে কি শান্তি আনতে পারবে?
জম্মু-কাশ্মিরের রাজধানীতে গুরুত্বপূর্ণ ডল লেকের পানিতে চিকচিক করছে জুলাইয়ের রোদ, হালকা ঢেউয়ের কারণে বেঁধে রাখা শিখারা উঠছে-নামছে। ডল লেকের পাশ দিয়ে বাসভর্তি হয়ে হিন্দুতীর্থযাত্রীরা যাচ্ছেন গুহামন্দির অমরনাথে। বাসের জানালা দিয়ে অনেকেই মন মাতানো ডল লেকের প্রকৃতির ছবি তুলছেন। বাসগুলো রয়েছে সেনাবাহিনীর গাড়ি বহরের মাঝখানে। দীর্ঘ গাড়ির বহর, ডিজেল চালিত যানে বসে আছেন সেনারা। তারা যাচ্ছে লাল চিনারের ভূমি ও তুষার আচ্ছাদিত হিমালয়ের পাহাড়ের দিকে। এটা সেই জায়গা যেটাকে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীর পৃথিবীর স্বর্গ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এটা সেই ভূস্বর্গ যা প্রায় হারানোর দিকে। এটা সেই ভূস্বর্গ যা ‘পুনরুদ্ধার’ করতে চাইছে ভারত।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের কাছে কাশ্মির ‘ইস্যু’ সমাধান প্রয়োজন। যে অসমাধিত ইস্যুটি সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪৭ সালে মহারাজা হরি সিং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মির উপত্যকাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। দুটি যুদ্ধ ও টানা তিন দশকের সশস্ত্র বিদ্রোহের পর ভারত সরকার মনে করছে অতীতের সরকারগুলো যা করতে পারেনি সেটাই করার এখনই সময়।

দ্বিতীয় মেয়াদে শক্তিশালী ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকার কাশ্মিরের চলমান অবস্থা থেকে উত্তোরণ চায়, বর্তমান সুবিধা বাতিল করে রাজ্যটিকে ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত করতে চায়। এতে যদি পুরো ব্যবস্থা ও পুরনো রাজনীতিকে বাদ দিতে হয় তবুও। একদিকে ভারত সরকার জঙ্গিবাদ দমন করতে চায় লৌহ হস্তে, অন্যদিকে তৃণমূল পর্যায়ে শাসন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে।

গত কয়েকদিন ধরেই ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা যে কাশ্মির তা দৃশ্যত দেখা যাচ্ছিল। ২৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী তার ‘মন কি বাত’ ভাষণে কাশ্মিরের উন্নয়ন ও সুশাসনের বিষয়ে কথা বলেছেন। কাশ্মিরিরা যে ভারতের প্রধান ধারায় যুক্ত হতে অধীর আগ্রহী সে কথাও তিনি বলেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তিনদিন কাটিয়েছেন উপত্যকায়। এরপরই অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উপত্যকায় অতিরিক্ত ১০ হাজার সেনা পাঠায়। কাশ্মিরের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের দাবি, রাজ্য পুলিশসহ সেখানে প্রায় ৭ লাখ নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। যা উপত্যকাকে বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকৃত এলাকায় পরিণত করেছে।

কাশ্মিরে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয় পার্লামেন্টে অমিত শাহের প্রথম প্রস্তাবেই। রাজ্যটির গর্ভনর সত্য পাল মালিক বলেন, কাশ্মিরের স্থানীয়রা শান্তি ও উন্নয়ন চায়। যে কোনও উদ্যোগ বাস্তবায়নের এটাই আদর্শ সময়।

ভারতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মনে করেন, সরকারের পেশি-শক্তি নীতি ইতিবাচক হিসেবে হাজির হচ্ছে। বিশেষ করে এলওসি দিয়ে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এটা কাজে আসছে। তিনি বলেন, স্থানীয় পরিষদ ও পঞ্জায়েত নির্বাচন সফলভাবে হয়েছে। অমরনাথ যাত্রাও হয়েছে নির্বিঘ্নে। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে অনুপ্রবেশ ছিল সবচেয়ে কম। এই বছরের শেষে প্রাদেশিক নির্বাচন আয়োজন করা হতে পারে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা এটাও জানান যে, হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানি নিহতের পর উপত্যকায় যে দীর্ঘ ও বড় ধরনের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে এই হত্যাকাণ্ডের পর কয়েক মাস নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে কাশ্মিরিদের সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায় এবং আহত হয় সহস্রাধিক। এই বছর জুনে নিরাপত্তাবাহিনী জাকির মুসাকে হত্যা করে। বুরহান ওয়ানি নিহতের পর মুসা হিজবুল কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেয়। মুসার উত্থান প্রমাণ দেয় কাশ্মিরের বিদ্রোহী সশস্ত্র পন্থায় তরুণরা ঝুঁকছে। মুসা কাশ্মিরে জিহাদের প্রতি পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাকতকারও অভিযোগ তুলেছে।

ভারত সরকার ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো মনে করে, কাশ্মিরকে মূল ভারতের সঙ্গে একীভূত করার ক্ষেত্রে ‘ক্ষুদ্র প্রতিবন্ধকতা’ দূর করা গেছে এবং কাশ্মিরের জনগণ যৌক্তিক উপসংহারে আসতে রাজি। বিজেপিবান্ধব প্রার্থীরা স্থানীয় নির্বাচনে ৪ হাজারের বেশি আসনে জয়ী হয়েছে। যদিও ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নির্বাচনটি বয়কট করেছিল। বিজেপি নেতারা বলছেন, পঞ্চায়েত প্রধানদের সুরক্ষা দিতেই উপত্যকায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। কারণ এই প্রধানরা ভারতের প্রতি অনুগত।

কাশ্মিরে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের পরই সেখানে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কাশ্মিরে কি জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করছে সরকার? শেষ পর্যন্ত কি ৩৭০ ধারা বাতিল করছে? আগেই ওমর আব্দুল্লাহ, মেহবুবা মুফতি, সাজাদ গানি লোন ও শাহ ফয়সালের মতো নেতারা ৩৭০ ধারা বাতিলের বিষয়ে হুঁশিয়ারি জানিয়ে আসছিলেন। তারা সরকারের যে কোনও ভুল পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

সোমবারের আগে অনেকেই জম্মু-কাশ্মিরকে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। কেউ কেউ বলছিলেন এটা অনেক বেশি হয়ে যায়। বিজেপির একাংশ মনে করে, এর ফলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ লাদাখে বৈষম্য কমবে।

কাশ্মিরকে বিভক্ত করার মধ্য দিয়ে উপত্যকায় সন্ত্রাসের ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়ে আসবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিশেষজ্ঞ ও প্রবীণ আরএসএস কর্মী সেশাদার চারি বলেন, এই অঞ্চলে শিয়া ও বৌদ্ধদের ভোট প্রয়োজন বিজেপির। এলাকাটি সব সময় শিয়া অধ্যুষিত। কিন্তু কয়েকটি গোষ্ঠীর কৌশলের কারণে সুন্নি ভোট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে এখানে বিজেপি কোনও নির্বাচনে জয়ী হতে পারে না।

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এখানেই কাশ্মিরকে বিভক্ত করার মূল কারণ নিহিত বলে মনে করছেন। এর ফলে বিধানসভা বা পার্লামেন্টারি আসন নতুন করে বিন্যাস করা যাবে।

ভারতীয় সংবিধানের যে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে কাশ্মিরকে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সোমবার সেটি বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সোমবার (৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পর এ ঘোষণা দেন তিনি। ইতোমধ্যে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এ সংক্রান্ত বিলও উত্থাপন করেছেন অমিত শাহ। আর ৩৭০ ধারা বাতিলের ঘোষণার পর কাশ্মিরজুড়ে নিরাপত্তা জোরদারের কথা বলে নতুন করে সেখানে সেনা সংখ্যা আরও বাড়ানো হলো।

কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন ও সেখানকার বাসিন্দাদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ণ করার দিনটিকে ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের ‘সবথেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন’ আখ্যা দিয়েছেন রাজ্যের মেহবুবা মুফতি। টুইটারে তিনি লিখেছেন,‘১৯৪৭ সালে জম্মু-কাশ্মির দুই জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে থাকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা হলো।’

সোমবার সরকারের সিদ্ধান্তের পর প্রতিক্রিয়ায় জম্মু-কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ বলেছেন, ভারত সরকারের আজকের একতরফা ও জঘন্য সিদ্ধান্ত জম্মু-কাশ্মিরের জনগণের সঙ্গে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাকতকতা। এই সিদ্ধান্তের ফল হবে দীর্ঘমেয়াদি ও বিপজ্জনক। এটা রাজ্যের জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন।

বিশ্লেষকরাও মনে করেন,ব্যাপক মাত্রায় সামরিকায়ন, নিরাপত্তা তল্লাশির সূত্রে হওয়া নির্বিচার হয়রানি ও স্বশাসনের অধিকার ক্ষুণ্ন করার মতো বিষয়গুলো স্থানীয়দের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ জাগিয়ে তুলছে। তাদের ঠেলে দিচ্ছে পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর দিকে। তার মধ্যে ৩৭০ ধারা বিলোপ করে স্বায়ত্তশাসনের আনুষ্ঠানিক অধিকারও কেড়ে নেওয়া হলো। সূত্র: আউটলুক ইন্ডিয়া।

No comments

Powered by Blogger.