‘বাতাসে উদ্বেগ’: বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন কাশ্মীরে অবস্থানের অনুভূতি কেমন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘নয়া কাশ্মীরে’ প্রথম যে শিশুদের জন্ম হলো, তাদের একজন ইমাদ তারিক। তার জন্ম হয় সোমবার ভোরে। কিন্তু তার পরিবারের কেউই জানে না যে তার জন্ম হয়েছে। তার বাবা ৪০ বছর বয়সী তারিক আহমেদ শেখ হাসপাতাল চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে জানালেন, “কেউই জানে না যে, আমার স্ত্রী সন্তানের জন্ম দিয়েছে। পরিবারের কাউকে জানাতে পারিনি আমরা, তারাও কেউ এখানে আসতে পারেনি”।

রোববার থেকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ইন্টারনেট, ল্যান্ডফোন এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে দিল্লী। ফলে সাত মিলিয়ন মানুষ এক ধরণের বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে এবং তাদের পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সাক্ষাতের কোন সুযোগ নেই। ভারত সরকার এখান স্কুলগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে এবং কাশ্মীর উপত্যকার বৃহত্তম শহর শ্রীনগরের সড়ক ও যোগাযোগের পথগুলোতে ব্যরিকেড দিয়ে রেখেছে।

গত সপ্তাহে কাশ্মীরে যে ৩৮,০০০ অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, তাদের সহযোগিতায় কর্তৃপক্ষ শতাধিক মানুষকে গ্রেফতার করেছে, যাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতারাও রয়েছেন। এদিকে বুধবার পুলিশ নিশ্চিত করেছে যে, শ্রীনগরে কারফিউ চলাকালে পুলিশের ধাওয়া থেকে পালাতে গিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু খুব অল্প কাশ্মীরীরাই এই খবরটা জানতে পারবে। তাদের অনেকেই জানবে না যে, সোমবার সকালে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে ঘোষণা দিয়েছেন যে, ভারত সরকার কাশ্মীরীদের বিশেষ স্ট্যাটাস বাতিল করেছে, সংবিধানের অধীনে ৭০ বছর ধরে যেটা বলবৎ ছিল।

শেখ জানান, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের খবর শোনার কয়েক মিনিট পরেই আমার ছেলের জন্ম হয়েছে। শেখ শ্রীনগরে অটোরিকশা চালান। তিনি আর তার স্ত্রী আরও আগেই হাসপাতালে এসেছিলেন। কারফিউয়ের গুজব শুনে আগে আগে চলে এসেছিলেন তারা। অন্য সব কাশ্মীরীদের মতো তারাও প্রশাসনের যুদ্ধ প্রস্তুতি দেখে বিস্মিত হয়েছে। সেই সাথে বিভিন্ন জরুরি আদেশও জারি করে প্রশাসন।

কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন বাতিল করার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে কাশ্মীরীরা ঘুম থেকে উঠে দেখেন যে রাজ্যের ইন্টারনেট চলতি বছরে ৫৩তম বারের মতো বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সকল মোবাইল ও ল্যান্ডফোন সার্ভিসও বিচ্ছিন্ন। জনগণ তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে, এবং সাংবাদিকরা তাদের রিপোর্ট পাঠানোর কোন মাধ্যম পাচ্ছেন না। কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় স্থানীয় পত্রিকার ওয়েবসাইটের প্রথম পাতাটি সাদা এবং আমাদের নিজেদের ওয়েবসাইটটিও সোমবার থেকে অফলাইনে আছে। আমার মতো অনেক সাংবাদিকই বিমানে কাশ্মীর ছাড়ছেন, এ ধরণের যাত্রীদের কাছে রিপোর্ট হস্তান্তর করছেন। খুব অল্প সংখ্যাক মানুষের স্যাটেলাইট ডিশ সংযোগ রয়েছে এবং তারা টিভি চ্যানেল দেখতে পাচ্ছেন। যানবাহনে মাইক লাগিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে যাতে কেউ বের হওয়ার চেষ্টা না করে। বোঝার কোন উপায় নেই যে, পরিস্থিতি শান্তি রয়েছে কি না। কোন যোগাযোগ না থাকায়, উপত্যকার বাতাস এখন উদ্বেগে পরিপূর্ণ।

পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা। দিনের বেলা শ্রীনগরের শ্রী মহারাজা হারি সিং (এসএমএইচএস) হাসপাতালটিতে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে মঙ্গলবার মধ্যরাতে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। চোখের চিকিৎসা বিভাগে ঢোকার সাথে সাথেই পাঁচ তরুণকে দেখলাম যারা ছড়ড়া গুলির আঘাতে আহত। হাসপাতালের সহকারীরা তাদের ব্যান্ডেজ বাঁধা চেহারায় বাতাস করছিল। সরকারের কর্মকর্তারা এই সপ্তাহে ছড়ড়া গুলি ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছে, কিন্তু ছড়ড়া গুলি কাশ্মীরে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

১৭ বছর বয়সী তরুণের সাথে থাকা ত্রিশোর্ধো লোকটি জানালেন, “আমি ওর প্রতিবেশী। বাড়ির বাইরে থেকে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করি আমি। দুই চোখেই ছড়ড়া গুলি লেগেছে ওর। অপারেশানের আগে ডাক্তার এখন তাকে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। বাম চোখেও এখন দেখতে পাচ্ছে না সে”। হাসপাতালের কর্মীরা জানালেন, ওই দিনেই এক ডজনের বেশি আহত তরুণ এসেছিল হাসপাতালে।

আরেকটি দিনের সূর্যোদয় হচ্ছে এবং আধাসামরিক বাহিনী তাদের বিধিনিষেধ আরোপ করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বহু কাশ্মীরীরাই মনে করছে, তাদের পরিচয় হুমকির মুখে পড়ে গেছে। অন্যেরা তাদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। সহিংস সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আতঙ্কে আছে তারা। আমাদের মতো অনেকেই আছি চরম অসহায়ত্বের মধ্যে – যেন আমাদের একটা অঙ্গ ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.