সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে অসন্তোষ: বাস্তবায়নে ধীরগতি by নূর মোহাম্মদ

১৫টি প্রকল্পের বাস্তবায়নের ধীরগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে মাত্র ৪২ শতাংশ বাস্তবায়ন হওয়ায় এ অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে চলতি অর্থবছর প্রকল্প থেকে কোনো অর্থ ফেরত না দেয়ার জন্য স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে প্রকল্প পরিচালকদের। তবে গত বছরের চেয়ে এবার একই সময় অগ্রগতির হার ১৩ ভাগ বেশি হওয়ার পরও এ অসন্তোষ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রকল্প পরিচালকরা। তারা বলছেন, নির্বাচনী বছর হওয়ায় প্রকল্প থেকে টাকা বের করে নিতেই এ চাপ দেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯শে মার্চ মাউশির অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে একটি সভা হয়েছে। সভায় মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. মাহাবুবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. মহিউদ্দিন খান। এছাড়া মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরসহ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় জানানো হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়নধীন ১৫টি প্রকল্পে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মোট বরাদ্দ ৩,৪৯২ কোটি ৮৯ কোটি টাকা। তার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ৩,১৮৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আর দাতাদের কাছ থেকে নেয়া ৩০৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। এডিবিতে বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থ ছাড়া হয়েছে ১,৮৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা মোট বরাদ্দের ৫৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ব্যয় হয়েছে ১,৪৯৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা; যা মোট বরাদ্দের ৪২ দশমিক ৯১ শতাংশ। বিগত বছরের একই সময় এর অগ্রগতির হার ছিল ২৯ দশমিক। বৈঠকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মহিউদ্দিন খান বলেন, বিগত অর্থ বছরের মাউশির আওতাধীন প্রকল্পগুলোয় এডিটির বরাদ্দের চেয়ে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি আনা যায়নি। তিনি প্রকল্প পরিচালকদের প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও গতি বাড়ানোর কথা জানান।
চলতি বছর সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) বরাদ্দ ব্যয় শতভাগ করার জন্য প্রকল্প পরিচালকদের অনুরোধ করেন। প্রকল্পের শতভাগ বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যত ধরনের সহযোগিতা দরকার পুরোটাই করা হবে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী বছর হওয়ায় প্রকল্পের শতভাগ বাস্তবায়ন দেখতে চাওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কোনো প্রকল্পের টাকা ফেরত যাতে না যায় সেজন্য সর্ব্বোচ সর্তক থাকতে বলা হয়েছে পিডিদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পে মোট ১৫টি প্রকল্প চলমান।
সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে এডিপিতে মাউশির অধীন ১৫টি প্রকল্পে তিন হাজার ৪২৯ কোটি ৮৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে জিওবির তিন হাজার ১৮৮ কোটি ৬৯ লাখ ও প্রকল্প সাহায্য ৩০৪ কোটি ২০ লাখ ২৮ হাজার টাকা। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থ ছাড় হয়েছে এক হাজার ৮৮১ কোটি ৭৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে খরচ হয়েছে এক হাজার ৪৯৮ কোটি ৮৫ লাখ ৯ হাজার টাকা। যা মোট বরাদ্দের ৪২ দশমিক ৯১ শতাংশ। বাকি সময়ে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। গত বছরও এডিপি বাস্তবায়নে সক্ষম হয়নি মাউশি। এজন্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে সভা করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। অর্থ খরচ করতে না পারার অন্যতম কারণ হচ্ছে কর্মকর্তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ। সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট (সেকায়েপ) প্রকল্পটি গত ডিসেম্বর মাসে শেষ হলেও বরাদ্দকৃত শত ভাগ অর্থ খরচ করতে পারেনি। চলতি অর্থবছরে ৩০৮ কোটি ১৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৮৮ কোটি ৭৯ লাখ ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ মোট বরাদ্দের ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ টাকা খরচ করতে পারেনি। প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাস পরেও প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন (পিসিআর) তৈরি করতে পারেনি কর্মকর্তারা। ঢাকা মহানগরীতে ১১টি স্কুল ৬টি কলেজ (সরকারি) নির্মাণ প্রকল্প: প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজেও গতি নেই। চলতি অর্থবছরে ৫৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরিতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৮ কোটি ৫১ লাখ ১৫ হাজার টাকার খরচ হয়েছে। শতাংশ হারে অগ্রগতি ৩২ দশমিক ৫৮ ভাগ। কয়েক মাস ধরে প্রকল্পের পরিচালক ও উপপরিচালক পদ শূন্য থাকায় কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। দুই দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পরে আরও এক দফা মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্রুত প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না দিলে চলতি অর্থ বছরের সংশোধিত এডিপির বরাদ্দ শেষ করা যাবে না। শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজগুলোর উন্নয়ন প্রকল্প: চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ২৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০৫ কোটি ৯৫ লাখ ২৫ টাকা খরচ হয়েছে। শতাংশ হিসেবে ৪২ দশমিক ৭৮ ভাগ অর্থ খরচ হয়েছে। গত বছর একই সময়ে ৭১ দশমিক ৫৯ শতাংশ খরচ হয়েছিল। সংশোধিত এডিপিতে আরও ১৮৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রকল্পভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের জন্য মাটি পরীক্ষা ও নকশা চূড়ান্ত না হওয়ায় দরপত্র আহ্বান আটকে আছে। ফলে বাকি সময়ে প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি অ্যাডুকেশন প্রকল্প: এডিপিতে ৫৯ কোটি ৩৬ লাখ ও আরডিপিতে ১৫ কোটি ৭৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ কোটি ৭৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে; যা মোট বরাদ্দের ২৬ দশমিক ৫১ ভাগ। গত বছর একই সময়ে খরচ হয়েছে ২৮ দশমিক ৯১ ভাগ। প্রকল্প পরিচালক মো. জহির উদ্দিন বাবর সভায় বলেন, এডিপির কনকুয়ারেন্স পেতে তিন-চার মাস লেগে যায়। এতে করে সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। সিলেট, বরিশাল ও খুলনা শহরে সাতটি সরকারি বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প: এডিপিতে ৩৫ কোটি ৪১ লাখ ও আরডিপিতে ১৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরিতে ১১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। যা মোট বরাদ্দের ৩২ দশমিক ১৮ ভাগ। গত বছর একই সময়ে ৩৭ দশমিক ২ ভাগ টাকা খরচ হয়েছিল। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের উন্নয়ন প্রকল্প: চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ১৫০০ কোটি ও আরডিপিতে ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে খরচ হয়েছে ৬৫৮ কোটি ৯১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। মোট বরাদ্দের ৪৩ দশমিক ৯৩ ভাগ টাকা খরচ হয়েছে। গত বছর এ হার ছিল ৫৮ দশমিক ৯৪ ভাগ। দীর্ঘদিন প্রকল্পের পরিচালক না থাকায় প্রকল্পের প্রকিউরমেন্ট কাজসহ সব কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। সেকেন্ডারি অ্যাডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) প্রকল্প: এডিডিতে ১ হাজার কোটি ও আরডিপিতে ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৩৯৪ কোটি ৩২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে; যা মোট বরাদ্দের ৩৯ দশমিক ৪৩ ভাগ। শুধু চলতি অর্থবছরে মোট বরাদ্দের অর্থ খরচ নয়, প্রকল্পের মেয়াদ আছে মাত্র ১০ মাস। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্প, পর্যায়-২এ ১০৯ কোটি তিন লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে মাত্র এক কোটি ২১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। যা মোট বরাদ্দের এক দশমিক ১২ শতাংশ। এর পরেও সংশোধিত এডিপিতে আরও ২৮৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বাকি সময়ের মধ্যে এই অর্থ খরচ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সভায় শঙ্কা প্রকাশ করছেন। আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার প্রচলন প্রকল্প পর্যায়-২: চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ২০ কোটি ও আডিপিতে ৭৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৭৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা। যা মোট বরাদ্দের তিন দশমিক ৭৯ শতাংশ। ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প: এডিপিতে দুই কোটি ২৬ লাখ ও আরডিপিতে দুই কোটি ২৬ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আর খরচ হয়েছে দুই কোটি ৩২ লাখ টাকা। যা মোট বরাদ্দের ১ দশমিক ০৩ ভাগ। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয় প্রকল্প ও সরকারি কলেজসমূহের বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্প: আরডিপিতে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রকল্পে পরিচালক নিয়োগ ছাড় কোনো কাজ শুরু হয়নি। জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্প এডিপিতে ৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা ও আরডিপিতে ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অডিট আপত্তির কারণে ১১ মাস ধরে কোনো টাকা খরচ করতে পারেনি প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
ন্যাশনাল একাডেমিক ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজাঅ্যাবিলিটিস প্রকল্প: এডিপিতে ৬০ কোটি ও আরডিপিতে ৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে দুই কোটি ২৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে; যা মোট বরাদ্দের তিন দশমিক ৭৩ ভাগ। গত বছর একই সময়ে বরাদ্দের হার ছিল পাঁচ দশমিক ৯১ ভাগ। উচ্চমাধ্যমিক উপবৃত্তি প্রকল্প: এডিপিতে ৪৯ কোটি ৮৭ লাখ ও আরডিপিতে ১৮৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে মাত্র ৯৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে; যা মোট বরাদ্দের ১ দশমিক ৯৬ ভাগ।
এ ব্যাপারে মাউশির পরিচালক (উন্নয়ন) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার বাস্তবায়নের হার বেশি যেমন তেমনি এবার এডিবিতে বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েছে। তবে এ অগ্রগতি আরও দ্রুত করার জন্য প্রকল্প পরিচালকদের তাগিদ দেয়া হয়েছে। নির্বাচনী বছরের বিষয়টি বাস্তবায়ন সেটা মানতে হবে। কারণ নির্বাচনী বছরের অন্যান্য বছরের চেয়ে প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান করার একটা চ্যালেঞ্জ সরকারের থাকে, সেভাবে একটা প্রস্তুতি আমাদের আছে।

No comments

Powered by Blogger.