ভেজালের চেয়ে ভয়াবহ খাবারে দূষণ

রাজধানীর হাতিরঝিল সংলগ্ন গাবতলা গলি। গত বুধবার মধ্য দুপুর। দমকা হাওয়া। উড়ছিল ধুলোবালি। ঘর্মাক্ত চার বছরের সন্তান রাকিবুল ইসলামকে নিয়ে থামলেন মা শিরিন আক্তার। আখের রস বিক্রেতা সাইদুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। গরমে সন্তানকে স্বস্তি দিতে একগ্লাস আখের রস চাইলেন শিরিন। সাইদুল এক বালতির জমানো ময়লা পানিতে গ্লাস চুবিয়ে ধোয়েন। তাতে আখের রস দিলেন। রাকিব এক চুমুকেই শেষ করলো গ্লাস। পর পর অপর ক্রেতা বৃদ্ধা ছকিনা বেগমকেও দিলেন একই পানিতে গ্লাস ধুয়ে। একইভাবে দিলেন রমিজ উদ্দিন নামে অপর এক ক্রেতাকে। এভাবে প্রতিদিন সাইদুলের বিক্রি ২০০ থেকে ২৫০ গ্লাস আখের রস। একই ময়লা পানিতে ধোয়া। খোলা পরিবেশে ধুলায় মাখামাখি। মাছির ভোঁ ভোঁ। বরফের পানির সঙ্গে মিশছে তার শরীরের ঘামও। কিন্তু একটু স্বস্তির জন্য ওই দূষিত পানীয় পান করে যাচ্ছে একে একে অনেকে।
এভাবে দূষণের সঙ্গে কেন রস তৈরি ও পরিবেশন করছেন জানতে চাইলে সাইদুল বলেন, বাসা দূরে হওয়ায় একই পানিতে ধুয়ে দিতে হচ্ছে। তাছাড়া সবাই তো ধুলাবালির মধ্যেই আখ চিবিয়ে রস বিক্রি করছে। তবে নানা দিক থেকে দূষণের কথা স্বীকার করলেন তিনি। কিছুটা এগিয়ে কাওরান বাজারের কাছে বিজিএমই ভবন। ভবনের সামনে তিন বছর ধরে ফুটপাতে বসে রাত-দিন খাবার বিক্রি করেন মো. সুজন। ফুটপাতে ৮ রকমের রান্না করা মাছ-মাংস-সবজির পসরা। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। খাবারে ভ্যান ভ্যান করছে মাছি। পানির ড্রামে চিক চিক করছে ভাসমান তেল। খাবার পাত্র, চারপাশে টাঙানো কাপড় ও বসার বেঞ্চ অপরিষ্কার। ওই অবস্থায় সুজনের খাবারের পসরা ঘিরে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন ৫ ব্যক্তি। বিজিএমইএ’র কর্মচারী কবির হোসেন, মতিঝিলের এক অফিসে কর্মরত আবদুল গফুর বাদশা, মহাখালীতে চাকরিরত নাছের উদ্দিন, গাড়ির হেলপার আবদুল আমিন ও পথচারী রফিক। এই প্রতিবেদক কাছে যেতেই একটি বাসন ধুয়ে এগিয়ে দেন। খাবার পানি চাইলেও দেয়া হয় একটি ড্রামের পানি।
বিক্রেতা সুজন বলেন, ফুটপাথে রান্না। ফুটপাথেই বিক্রি। একবার রান্না করলে ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা পরও পরিবেশন করা হয়। রয়ে গেলে নতুন রান্না করা খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়। পাশের একটি নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করি। তাতে চলে সীমিত ধোয়া-মোছা। আমরা তো ফুটপাথে দূষণের সঙ্গে খাবার পরিবেশন করি। কিন্তু বিভিন্ন হোটেলেও তো এভাবে প্রতিনিয়ত ভেজাল খাবার খাওয়ানো হচ্ছে।
ক্রেতা কবির, বাদশা, নাছের, আমিন ও রফিক বলেন, কর্তৃপক্ষের সামনেই এভাবে অহরহ ভেজাল ও দূষিত খাবার বিক্রি হচ্ছে এবং আমরা নিরুপায় হয়ে খাচ্ছি। এতেই তো আমরা নানা অসুখ-বিসুখে ভুগছি।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, শুধু ফুটপাথের খাবার নয়। রাজধানীতে সব ধরনের খাবারের লক্ষাধিক উৎপাদন, আমদানি, পরিবহন, সংরক্ষণ, বিপণন ও পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান নানাভাবে খাবারে দূষণ ছড়াচ্ছে। সারা দেশে এসবের সঙ্গে জড়িত অন্তত ১৫ লাখ খাদ্য ব্যবসায়ীর অধিকাংশের পরিবেশন করা দূষিত খাবার মানুষ খাচ্ছে। শুধু তাই নয়। বাসা-বাড়িতেও যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও উৎপাদনের প্রক্রিয়া না জানার কারণে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে দূষিত খাবার গ্রহণ করছে অনেকেই। এতে ছড়াচ্ছে জীবাণুর সংক্রমণ। দূষণের শিকার অনিরাপদ খাদ্যের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে ২০০ রকম রোগ। শুধু দূষিত খাবার গ্রহণের ফলে প্রতিবছর প্রতি ১০ জনে ১ জন লোক অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এতে বছরে মারা যাচ্ছে ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ। খাদ্যে ভেজালের চেয়েও দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে দাবি করেছে সংস্থাটির।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ মাহফুজুল হক মানবজমিনকে বলেন, খাবারে ভেজালের চেয়ে দূষণটা অনেক বেশি। আমাদের পরীক্ষায় ২৮টি খাদ্যপণ্যের অধিকাংশেই ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম। অর্থাৎ খাবার যত না ফরমালিন, রং ইত্যাদি মেশানোর মাধ্যমে ভেজাল করা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে দূষণ। বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিচার্স কাউন্সিলের এক গবেষণায় উঠে এসেছে ৯৭ ভাগ জারের পানি দূষিত। আমাদের এক চলমান গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদন এবং জবাই ও একই পানিতে চুবানোর কারণে মুরগির মাংসে জীবাণুর সংক্রমণ গেছে। ভারি ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পানি দূষিত হওয়ায় মিঠা পানির মাছেও ভারি ধাতু পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে কোরবানির পশুর মাংসেও দূষণ পাওয়া যাচ্ছে। কাঁচাবাজারসহ ভোগ্যপণ্য যথাযথভাবে উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, বিপণন ও পরিবেশন না হওয়ায় দূষণটা বাড়ছে। এতে নানা অসুখ-বিসুখে ভুগছে ভোক্তারা।
রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি আরো জানায়, বিভিন্ন কারণে খাদ্যে দূষণ ক্রমেই বাড়ছে। খাবার উৎপাদন ও সংরক্ষণে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য (যেমন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট), কীটনাশক (যেমন, ডিডিটি, পিসিবি তেল ইত্যাদি), রঞ্জক বা সুগন্ধি, তেজস্ক্রিয় বা ভারি ধাতুর ব্যবহার, ভেজাল মিশ্রণ, নিম্নমানের খাবার উৎপাদন, ক্ষতিকর প্রক্রিয়ায় উৎপাদন, ক্ষতিকর কীটনাশক বা অনুজীবের ব্যবহার, খাবারে পচন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্তদের দ্বারা পরিবহন ও পরিবেশন, কাঁচা-পচা ও রান্না করা খাবার এক স্থানে রাখা, খোলা খাবারে মাছি ও কীটপতঙ্গ দ্বারা জীবাণুর বিস্তার, হাঁচি-কাশি-অপরিচ্ছন্ন হাতের ছোঁয়া, নির্ধারিত তাপমাত্রায় না রাখা ইত্যাদি কারণে খাবার দূষিত হচ্ছে। এই দূষণ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ। এসব দূষণের সিংহভাগই হচ্ছে অসচেতনতা ও অপরিচ্ছন্নতার কারণে। মানুষের সচেতনতার মাধ্যমে তা অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায় বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক এস.এম আমিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে রয়েছে অন্তত ২ হাজার রকম খাবার। দূষণ ও ফুড পয়জনিংসহ বিভিন্নভাবে বহু খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। না জেনে সেই খাবার আমরা গ্রহণ করি। অথচ সবাই সচেতন হলে খাবার দূষণ অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। অবশ্য দূষিত ও ভেজাল খাবার বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.