চাঁদা তুলে ভুয়া চিকিৎসকের খরচ জোগান শাহানা by এনা হাসান

উন্নত চিকিৎসার জন্য শাহানা দালালের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতাল থেকে গিয়েছিলেন বেসরকারি হাসপাতালে। ডাক্তার পরিচয়ে হাসপাতালের ম্যানেজার জানিয়েছেন, দ্রুত অপারেশন করতে হবে। নতুবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে। অপারেশন করতে প্রয়োজন তিন লাখ টাকা। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। এতো টাকা পাবেন কোথায়। তবে যে কোনোভাবেই একমাত্র শিশু সন্তান সামিয়াকে বাঁচাতে চান মা-বাবা। ঋণ করেন। পথে পথে মানুষের কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য হাত পাতেন। তারপর অপারেশন হয়েছে ছোট্ট মেয়েটির পায়ে। টাকাও গেছে। কিন্তু সুস্থ হয়নি মেয়েটি। ভুল চিকিৎসায় এখন পা হারাতে বসেছে ছয় বছরের সুমাইয়া।
সুমাইয়ার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। একবছর আগে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পায় সুমাইয়া। ব্যথা বাড়তে থাকলে চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় এনে ভর্তি করা হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল)। জরুরি বিভাগে সুমাইয়াকে দেখাতে নিয়ে গেলে সামিয়ার বাবা মায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় দিতি নামের এক মহিলার সঙ্গে। নিজেকে পঙ্গু হাসপাতালে কর্মরত পরিচয় দেন তিনি। পঙ্গুতে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো হবে না বলে সামিয়াকে ভালো ও দ্রুত চিকিৎসার জন্য পাশের ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যান দিতি। ক্রিসেন্ট হাসপাতালে কর্মরত ম্যানেজার হাসান নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে সামিয়ার বাবা-মা’কে বলেন, আপানারাতো দেরি করে ফেলছেন। এই মেয়ের পায়ে তো ক্যান্সার হয়ে যাবে। দ্রুত অপারেশন না করলে এই পা কেটে ফেলতে হবে। অপারেশন করাতে নগদ তিন লাখ টাকা দাবি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মেয়ের এই করুণ অবস্থা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েন মা শাহানা আক্তার। ডাক্তারের কাছে অনুরোধ করেন টাকার পরিমাণ কমানোর জন্য। তখন তাকে বলা হয় এখন এক লাখ টাকা জমা করতে বাকিটা অপারেশনের আগে পরিশোধ করতে। শাহানা বলেন, আমার আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় মা’কে বলে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলন করি এক লাখ টাকা। এরপর বাকি দুই লাখ টাকা গ্রামের বাজারে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে, বিভিন্নভাবে ধার-দেনা করে যোগাড় করি। আমার সংসার জীবনের তের বছর পর আমি মেয়েটারে পাইছি। সেই মেয়ের এমন অবস্থা হবে তা ভাবতেই পারি নাই। মেয়ের জন্য পথে পথে ঘুরছি। ঢাকায় আমার থাকার জায়গা ছিলো না। কোনো মতে এক জায়গায় রাত পার করে ডাক্তার দেখাইছি।
মাত্র ২১ দিনের মধ্যেই সামিয়া দৌড়ে বেড়াবে এমন আশ্বাস দেয় ক্রিসেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ছোট্ট সামিয়া আবার আগের মতো ঘরজুড়ে দৌড়ে বেড়াবে। মেতে উঠবে খেলায়। স্বপ্ন দেখেন বাবা-মা। কিন্তু অপারেশনের ২১ দিন পর পায়ের রড খোলার জন্য সামিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে এলে সেই স্বপ্নে ফাটল ধরে। পায়ের ভিতরের রড ছুটে গেছে বলে সামিয়াকে আবার অপারেশনের কথা বলেন ডাক্তার। এরপর কখনো দুই সপ্তাহ, কখনো এক মাস আবার কখনো তিন মাস পরপর পা দেখার অজুহাতে হাতিয়ে নেয় আরও লাখ দেড়েক টাকা। এ রকম করেই দেড় বছর। এর মাঝে অন্য জায়গায় ডাক্তার দেখাতে গেলেও ফিরে আসতে হয় তাদের।
এবার দেখা করতে চান ক্রিসেন্ট হাসপাতালের মালিক নুরুন্নবীর সঙ্গে। দেখা করেও আশার আলো দেখতে পাননি তারা। বরং নানাভাবে অপদস্তের শিকার হন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশে দেবেন এমন হুমকিও শুনতে হয়। শাহানারা আক্তার যোগাযোগ করেন র‌্যাব’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের সঙ্গে। জানান পুরো ঘটনাটি। ঘটনার সত্যতা যাচাই করে ২৮শে মার্চ র‌্যাব’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্ব ক্রিসেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালানো হয়। উদ্ধার করা হয় ২২ রোগীকে। যাদের সবাই ভুল চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ধরে এই হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসাধীন এইসব রোগীর মধ্যে সুমাইয়া আক্তার সামিয়া একজন। ভুল চিকিৎসার ফলে বর্তমানে সামিয়ার পায়ে পচনের সৃষ্টি হয়েছে। সামিয়া এখন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন অব ট্রমালজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন-নিটোর (পঙ্গু হাসপাতাল) এর পরিচালক ডা. আবদুল গণী মোল্লার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন।

No comments

Powered by Blogger.