কবি সাযযাদ কাদির এবং আমার চিত্র সাংবাদিকতা by প্রণব মজুমদার

পড়াশোনা, সাহিত্য চর্চা এবং মফঃস্বল সাংবাদিকতা একসঙ্গে করেছি। তারপর উচ্চতর শিক্ষায় ঢাকায় আসা। আমার জীবনের উল্লিখিত ৩টি কাজ এখনও অব্যাহত রয়েছে। তবে এখন মফঃস্বল সাংবাদিকতা নয়! করছি জাতীয় সাংবাদিকতা। মনে পড়ছে ঢাকায় আমার সাংবাদিকতা শুরু চিত্রসাংবাদিকতার মাধ্যমে। কবি ও সাংবাদিক সাযযাদ কাদির তখন রাজধানীর নীলক্ষেত বাবুপুরায় তারকালোক এ সম্ভবত নির্বাহী সম্পাদক। সম্পাদক কথাশিল্পী আরেফিন বাদল। আমি প্রদায়ক। প্রথম লেখা একটি সাক্ষাৎকার। তারকালোক এ প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো- একজন দীবার কথা। ‘বাবা বলে গেলো আর কোনোদিন গান করো না’ খ্যাত দেশের চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক শিশুশিল্পী শামীমা ইয়াসমিন দীবা। স্পষ্ট মনে আছে রাজধানীর মগবাজার মধুবাগে নিজেদের বাড়িতে থাকেন দীবা। পড়েন তখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে এম.বি.বি.এস প্রথম বর্ষে। লেখাটা ছাপার পর সাযযাদ ভাই ৫০ টাকা বিল করেছিলেন। সেই টাকা দিয়ে ৫ জন সহপাঠী মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ক্যাফেটেরিয়ায় ৫ টাকা মূল্যমানের বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। পরে রোকেয়া হলের সামনে হাকিম ভাইয়ের দোকানে চা পান।
পড়াশুনার সুবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে থাকি। হলের সন্নিকটে নীলক্ষেত। তাই তারকালোক, কিশোর তারকালোক এবং আগামীতে লিখতাম। সম্মানীও পেতাম। তা যৎসামান্য হলেও আরেফিন ভাইয়ের ছোট ভাই আবদুল্লাহ আল বকর, প্রতিবেদক তারেক মাহমুদ, ইয়াহিয়া মীর্জা, বাম নেতা প্রবীণ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, গীতিকার জীবন চৌধুরী এবং সাযযাদ কাদিরের আন্তরিকতা ও জম্পেশ আড্ডার টানে যেতাম। এর মধ্যে সাযযাদ ভাই ছিলেন সত্যিকারের সাংবাদিকতা পেশার শিক্ষক। কাছে টেনে নিতেন তরুণদের। অনুবাদ শিখেছি উনার কাছে। জীবনদার কাছে জানলাম তিনি বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। টাঙ্গাইল করটিয়া সাদাত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন তিনি এবং জীবন চৌধুরীর সহধর্মিণী মৈত্রী সাহা ওনার ছাত্রী ছিলেন। সেই সুবাদে জীবনদাকে সাযযাদ ভাই জামাই বলে সম্বোধন করতেন। সাযযাদ ভাই সম্পর্কে এসব তথ্য জানার পর ব্যাকরণসম্মতভাবে লেখার অভিপ্রায়ে ওনার পিছু ছাড়িনি। সাহিত্য ও সাংবাদিকতা যা হোক না কেন লেখালেখিতে অনেক পরামর্শ ও সহযোগিতা পেয়েছি। আমার জানা মতে এদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির একজন বিদগ্ধ প্রাজ্ঞজন ছিলেন কবি সাযযাদ কাদির। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়ও ওনাকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। শিক্ষকতা থেকে সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় তাঁর সুষম সমন্বয়। সংবাদ ও অন্যান্য দৈনিকে প্রকাশিত আমার লেখাগুলোর ব্যাকরণগত ত্রুটি শুধরে দিতেন। শেখার জন্য ওনার কাছে তার সাংবাদিকতা কর্মস্থল তারকালোক, দৈনিক দিনকাল, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট ও মানবজমিন এ গিয়েছি। সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে আড্ডা হয়েছে আমাদের। বিতর্কও হয়েছে কিন্তু কোনোদিন মনোমালিন্য হয়নি!
গতবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার শেষ সময়ে বাংলা একাডেমিতে দেখা। সেবার কানাডা প্রবাসী বন্ধু কবি মৌ মধুবন্তী এবং অন্য বন্ধুদের সঙ্গে সাযযাদ ভাইয়ের ছবিও ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছিল! অনেকের সেলফোন সেটের ক্যামেরা দিয়ে ওনার সঙ্গে ওনার অনেক ভক্তের দলবদ্ধ ছবি তুলে দিয়েছি। তখন কি জানতাম তিনি ক’মাস পর দৈহিকভাবে বিশ্বভুবন থেকে মুক্তি নেবেন ?
এবারের বই মেলায় আমি বেশ সরব ছিলাম। তার বড় কারণও ছিল। অন্যতম প্রধান কারণ ৩০ বছর পর আমার পুনঃজন্ম লাভ! বইয়ের লেখক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। যার কারণে মেলাতে গিয়েছি বেশির ভাগ সময়। আগের বারের চেয়ে এবার আনন্দে বেশ বই কিনেছি। অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে গিয়ে দুর্বল রচনাও কিনেছি! তবে আরেকটি প্রাপ্তির মধ্যে ছিল বহু বছর পর পুরানো লেখক বন্ধুদের সান্নিধ্য লাভ। এত সরব থাকার পরও আমার কাছের মানুষ সাহিত্য ও সাংবাদিকতার প্রথম শিক্ষক কবি সাযযাদ কাদির ভাইকে প্রায় প্রতিদিনই মনে পড়েছে। সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সমাজসেবাসহ নানা শাখায় একুশে পদক বা বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাবার ক্ষেত্রে স্বকর্ম নয় বরং নিজের লোক বলে বিবেচিত যোগ্যতাকেই বেশি অগ্রাধিকার ও বিবেচনা করা হয় ! তা না হলে কবি সাযযাদ কাদির পণ্ডিত হয়েও কেন পেলেন না জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ? বিষয়টি আমাকে এখনও যন্ত্রণা দিচ্ছে ! লেখালেখির জগতে অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন কবিতায় তিনি একুশে পদক পাবেন! গত বছর আমিও আশা করেছিলাম তিনি পাবেন কবিতায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ! কিন্তু ভিন্ন মতের ব্যক্তি হওয়ায় জীবদ্দশায় মূল্যহীন কি থেকে গেলেন জীবনবাদী কবি সাযযাদ কাদির ?
সহকর্মী সাংবাদিক এবং সৃজনশীল কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিপ্রিয় এবং রসবোধসম্পন্ন মানুষ কবি সাযযাদ কাদিরের আজ জন্মদিবস। বেশ ঠোঁটকাটা এবং অসীম সাহসী এই ব্যক্তির জন্মদিনে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: সাহিত্যিক, দৈনিক শিরোনাম (কুমিল্লা) এর ঢাকা ব্যুরো প্রধান এবং পাক্ষিক অর্থকাগজ এর সম্পাদক
reporterpranab@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.