চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধারের নামে প্রতারণা by মহিউদ্দিন অদুল

মোফাজ্জেল হোসেন মৃধা একজন স্কুল শিক্ষক। খিলগাঁওয়ের শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলা পড়ান। ব্যস্ততম রাজধানীতে সময় বাঁচিয়ে সহজ পরিবহনের জন্য ব্যবহার করেন মোটরসাইকেল। গত ৮ই ফেব্রুয়ারি মোটরসাইকেলে চড়ে যান জোড়পুকুর পাড় মাঠের কাছে নিজের ফার্নিচার কারখানায়। রাত আটটার দিকে গাড়িটি ওই মাঠ সংলগ্ন ২১৭/সি নাবিল লন্ড্রির সামনে রেখে নিজের প্রতিষ্ঠানে ঢুকেন। কিছুক্ষণ পরই রাত ৮টা ১৮ মিনিটে গাড়িটি নিয়ে চম্পট দেয় চোরাই চক্রের সদস্যরা। কিছুক্ষণ পর তিনি গাড়ি রাখার স্থানে ফেরেন। কিন্তু তার প্রিয় বাহনটি আর নেই। পরে জানা যায় ওই গাড়ি চুরি করে নিয়ে যায় রাজিব মুন্সী। সঙ্গে ছিল অপর সহযোগী। মোটরসাইকেল চুরিতে তার মুন্সিয়ানাও অন্যান্য চক্রগুলোর কাছে বেশ পরিচিত। চুরির পরই ওই গাড়ি চলে যায় শরীয়তপুরে।
মোটরসাইকেল চুরির পর এবার রাজীব নামে উদ্ধারের নামে নতুন প্রতারণায়। দু’দিন পর গাড়ির মালিক মোফাজ্জেল হোসেনকে ০১৬৪২-২১৮৮৩৭ মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে। জানতে চায়, আপনার কী কোনো মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে? হ্যাঁ, বলে জবাব দিতেই গাড়ির বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে জানতে চায় তার গাড়ি সেই রকম কিনা। এরপর বলে আপনার গাড়ি অ্যাপাচি আরটিআর লাল-কালো ঢাকা মেট্রো ল-১৮-০৬৯৩ নম্বরের গাড়ি কিনা। সবই মিলে যাওয়ার পর রাজীব ০১৯০৮-৪৭৬৭৭৬ নম্বর থেকে ইমোতে ওই গাড়ির ৪টা ছবি পাঠায় মোফাজ্জেলকে। নিশ্চিত ও আশ্বস্ত করে যে সেটিই তার হারিয়ে যাওয়া মোটরসাইকেল। তারপর বলে গাড়িটি চুরির পর বেনাপোলে আমার বাড়ির কাছে এক ব্যক্তির কাছে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে। গাড়িটি কেনার নামে আটকানোর জন্য ১০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে আমি আটকাচ্ছি। আপনি ১০ হাজার টাকা ব্যক্তিগত বিকাশে নম্বরে পাঠিয়ে দেন। বিকাশের এজেন্ট নম্বর দিতে রাজি না হওয়ায় তার বিভিন্ন চাতুর্য্যে সন্দেহ ঘনিভূত হয়।
কিন্তু টাকা না পাঠিয়ে মামলা দায়ের ও খিলগাঁও থানা পুলিশের সহায়তা নেন মোফাজ্জেল। পুলিশ মোবাইল ট্র্যাকিং করে জানতে পারে মোবাইল ব্যবহারকারী বেনাপোলে নয়, অন্য স্থান থেকে কথা বলছে। এরপর দুর্বৃত্তদের নানা নাটকীয়তা অতিক্রম করে খিলগাঁও থানা ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সেই চোরাইচক্রকে গ্রেপ্তার করে। উদ্ধার করে মোটরসাইকেলটিও। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগ গত কয়েকদিনে রাজধানী ঢাকা থেকে এমন নানা অভিনব কায়দায় চুরি ও চুরির পর বিভিন্ন জেলায় পাচার হওয়া ১৮টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে। ডিবি পশ্চিম ৪ জন ও পূর্ব বিভাগ ৫ জন করে মোট ৯ মোটরসাইকেল চোরকে আটক করেছে।
শুধু এ দু’চোরাই চক্র নয়। তাদের হাত ধরে পুলিশ আরো অন্তত ৬ মোটরসাইকেল চোর চক্রের সন্ধান পেয়েছে। চুরির পর প্রতারণাই নয়। চুরির সময়ও তারা নেয় অভিনব কৌশল। প্রথমে কোন একটি মোটরসাইকেলকে টার্গেট করে। আরোহী মোটরসাইকেল রেখে কিছুটা আড়াল হলেই আচার-আচরণে নিজেই মালিক বনে যায়। সঙ্গে থাকে সহযোগী। এরপর টার্গেট করা মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা ব্যাপক সংখ্যায় পার্ক করা মোটরসাইকেলের সারি থেকেই টার্গেট করে। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা ক্লিনিকের সামনে পার্ক করা মোটর মেডিকেল এসিস্ট্যান্টদের মোটরসাইকেল বেশি শিকারে পরিণত হচ্ছে। এর কারণ বেশি সংখ্যায় থাকা মোটরসাইকেলের ভিড়ে নিজে চালক বনে চুরি করতে সহজ।
তেমনই এক ভুক্তভোগী আবদুল কাদের। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী হলেও গত ২রা জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক আত্মীয়কে দেখতে গিয়ে মোটরসাইকেল রাখেন আরো কয়েক মেডিকেল এসিস্ট্যান্টের গাড়ির সঙ্গে। স্বজনকে দেখে নিচে নেমে দেখেন তার গাড়ি নেই। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন তাকে বলেন যে, আমাদের সামনেই দু’লোক একটা মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে। আমরা তো স্বাভাবিক আচার-আচরণ দেখে তাদেরকেই মালিক মনে করেছি। তখনই তিনি জানতে পারেন যে, সেভাবে আরো বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্য সহকারীর মোটরসাইকেল চুরির কথা।
মোফাজ্জেল বলেন, আমার মোটরসাইকেল চুরির পর আবার উদ্ধারের ফাঁদ পেতে টাকা হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল প্রতারকরা। পরে জানতে পারি তারা ওই মোটরসাইকেল ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে পার্টস ইত্যাদি পরিবর্তন করে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে বিক্রি করে দেয়।
এদিকে গত মঙ্গলবার রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ডিবি পশ্চিম বিভাগ একে একে গ্রেপ্তার করে মো. রাজীব মুন্সী, আবদুুর রহমান, জাকির হোসেন ও মোক্তার হোসেনকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ১২টি মোটরসাইকেল। প্রায় একই সময়ে ডিবি পূর্ব-বিভাগ আটক করে আরো ৫ মোটরসাইকেল চোরকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় আরো ৬ টি মোটরসাইকেল। তারা মোটরসাইকেলগুলো চুরি করে বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের মেরামত কারখানায় নিয়ে পার্টস পরিবর্তন করে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে আবার বিক্রি করে দেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. আবদুল বাতেন বলেন, বেশি করে পার্ক করা মোটরসাইকেলের মাঝখান থেকে তারা কাউকে বুঝতে না দিয়ে দ্রুত মোটরসাইকেল নিয়ে পালায়। সেখানে স্বয়ং মালিক উপস্থিত থাকলেই হয়তো তা বুঝবেন। চুরির পর তা নিয়ে চলে যায় মাদারীপুর, শিবচরসহ বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামের কারখানায়। সেখানে চোরাই মোটরসাইকেলগুলোর একটার পার্টস অন্যটাতে উলট-পালট করে লাগায়। তারপর সেভাবে আবার কাগজপত্রও তৈরি করে। বিক্রি করে দেয়। রাজধানীতে এমন বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাদের পুরো চোরাই প্রক্রিয়া নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।

No comments

Powered by Blogger.