আওয়ামী লীগে নতুন মুখের কাফেলা by কাজী সোহাগ

আগামী নির্বাচনে ‘বিতর্কিত’ নেতাদের বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। জনসম্পৃক্ত ও ভাবমূর্তি ভালো এমন নেতাদের সামনে আনতে চায় দলটি। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে রাজনীতিতে আসা নতুন মুখকে। দলের এ মনোভাবের কথা এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী অনেকে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে তাদের প্রচারনা ততই বাড়ছে। মিটিং, মিছিল, সমাবেশসহ দলীয় কর্মসূচিতে তারা থাকছেন সক্রিয়ভাবে। এভাবে নির্বাচনকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের নতুন মুখের কাফেলা দীর্ঘ হচ্ছে। আওয়ামী লীগের বেশ ক’জন নীতি-নির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা জানান, আগামী নির্বাচনে অন্তত ৪২ জেলার ৮৫ আসনে নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। যদিও শেষ মুহূর্তে দলীয় প্রার্থিতা অনেকাংশে নির্ভর করে প্রতিপক্ষের প্রার্থী মনোনয়নের উপর। নেতাকর্মীদের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এলাকায় সুপরিচিত, মানুষের কল্যাণে কাজ করেন, দক্ষ সংগঠক, সৎ, নিষ্ঠাবান ও শিক্ষিত, এমন ব্যক্তিরাই দলীয় প্রতীক পাবেন। সাংগঠনিক কাজে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও দলীয় আদর্শকে ধারণ করেন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে মনোনয়ন দেয়ার সম্ভাবনাও আছে। দলের হাইকমান্ড এসব যোগ্যতাসম্পন্ন নেতাদের সারা দেশ থেকে বাছাই করছে। এবার প্রায় দুইশ’ আসনে এমন প্রার্থী দেয়া হবে যারা লড়াই করে বিজয় নিশ্চিত করতে পারবেন। আবার ক্ষেত্রবিশেষে বিএনপি’র প্রার্থীর প্রভাব, গ্রহণযোগ্যতার বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন নির্ভর করবে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা শুধু ঢাকার আসনগুলো নিয়ে মানবজমিনকে বলেন, ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৬টি আওয়ামী লীগের। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির একটি, ওয়ার্কার্স পার্টির একটি, স্বতন্ত্র একটি ও বিএনএফ’র একটি। সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের ১৬টির মধ্যে চারটিতে নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। গাজীপুরে বদল হতে পারে দু’টি আসনের প্রার্থী। নরসিংদীতে বদল হতে পারে দু’টিতে। সম্প্রতি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দলের সাংগঠনিক সফর শেষ করে আসা কেন্দ্রীয় এক নেতা মানবজমিনকে জানান, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ায় দু’টি আসনে পরিবর্তন হতে পারে। চুয়াডাঙ্গায় বদল হচ্ছে একটি আসন। ঝিনাইদহ জেলায় নতুন প্রার্থী আসছেন তিনটি আসনে। যশোরে চরমভাবে এলাকায় বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন তিন এমপি। মাগুরায় পরিবর্তন হচ্ছে একটি আসনে। খুলনায় নতুন মুখ আসছেন তিনটি আসনে। নতুনদের গুরুত্ব দেয়া প্রসঙ্গে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি যেমন দেশ গঠনের তেমনি নেতৃত্ব গঠনেরও। নতুনদের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সবসময় উদার। নতুনদের অগ্রাধিকার দেয়া হলে প্রজন্ম রাজনীতির বিকাশ ঘটে। পাশাপাশি সিনিয়রদের গুরুত্বও কম না। কারণ তাদের ঝুলিতে রয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা ও অর্জন। আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী তালিকার বেশ বড় একটা অংশ থাকবে তরুণদের দখলে। নতুন মুখগুলোর বেশির ভাগই সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ-সমর্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন মনোনয়ন দৌড়ে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এলাকায় মাঠপর্যায়ে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। নতুনদের এ তালিকায় রয়েছেন, শরীয়তপুর-২ আসনে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, রাজবাড়ী-২ আসনে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা শেখ সোহেল রানা টিপু, ঢাকা-১৫ আসনে স্বেচ্ছাসেবকলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, মাগুরা-১ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব এডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর, ফেনী-৩ আসন (সোনাগাজী-দাগনভূঞা) অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল (নেত্রকোনা-৩), আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন, সচিব আবদুল মালেক (পটুয়াখালী-১), কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী (লক্ষ্মীপুর-৪) ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী (চাঁদপুর-৩), উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম (চট্টগ্রাম-১৫), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি), কেন্দ্রীয় নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাংবাদিক ও পেশাজীবী নেতা রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, কক্সবাজার ৩ আসনে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ জয়, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য এবিএম রিয়াজুল কবীর কাওছার (নরসিংদী-৫), নেত্রকোনা-৫ আসন থেকে আাওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন, সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজ, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে প্রচারণায় নেমেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ফরিদপুর-১ আসনে সাবেক ছাত্রনেতা এবং ঢাকাটাইমস ও সাপ্তাহিক ‘এই সময়’ সম্পাদক আরিফুর রহমান দোলন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, বাগেরহাট-৪ আসনে সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি এইচএম. বদিউজ্জামান সোহাগ, চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন, আলোচিত অন্যদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় সদস্য মারুফা আক্তার পপি (জামালপুর-৫), নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু, হাসান আলী (সিরাজগঞ্জ-১), হাবিবুর রহমান স্বপন, চয়ন ইসলাম (সিরাজগঞ্জ-৫), গাইবান্ধার-৫ সাঘাটা ফুলছড়িতে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন। নতুন মুখ হিসেবে মনোনয়ন প্রত্যাশা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম মানবজমিনকে বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় পারিবারিকভাবে আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে। বলা যায়, জন্মগতভাবে আমরা মানুষের সঙ্গেই আছি। দলের দুঃসময় থেকে শুরু করে সব সময় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের একজন পরীক্ষিত নেতা হিসেবে আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি। একই প্রসঙ্গে অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী ও আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, স্বাভাবিকভাবে এলাকার মানুষ রাজনীতিবিদদের কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। বিশেষ করে বিপদে-আপদে নেতাদের পাশে পেতে চায়। রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে উন্নত জীবন পাওয়ায় তাদের প্রত্যাশা। আমি নির্বাচনী এলাকার মানুষদের এ ধরনের প্রত্যাশা উপলব্ধি করে তাদের পাশে থেকে কাজ করছি। আরও কাজ করতে চাই। এদিকে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় দফায় দফায় সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক জরিপ পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব জরিপ প্রতিবেদনে বর্তমান এমপিদের ভালো ও মন্দ কাজের পর্যালোচনা করেই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। ইতিমধ্যে পরিচালিত একাধিক জরিপ রিপোর্ট দলের হাইকমান্ডের হাতে রয়েছে। প্রতিটি রিপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে এলাকায় জনপ্রিয় এমপিরা যাতে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বাদ না পড়েন সেটিও হাইকমান্ডের বিবেচনায় রয়েছে। পাশাপাশি ওই এলাকার অবস্থা, অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, এলাকায় তাদের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিতর্কিত এমপিদের স্থলে এবার নতুন মুখ দেখা যেতে পারে বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আগামী নির্বাচনে কোন ধরনের প্রার্থী দলের পছন্দ সেটা বারবার বলে আসছেন। কোনো ধরনের বিতর্কিত ভাবমূর্তির কোনো জনপ্রতিনিধিকে এবার মনোনয়ন দেয়া হবে না সেটাও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গত এক বছর ধরে প্রার্থী বাছাই নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। তারই অংশ হিসেবে বিতর্কিত অনেককে ডেকে এনে সংশোধন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকমান্ড। এরপরেও যারা সংশোধন হননি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া হবে বলে দলীয় সূত্র জানায়।

No comments

Powered by Blogger.