গুজবে কান দেবেন না

চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ও তার অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। খালেদা জিয়াকে   ছাড়াই বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে যেতে পারে- রাজনৈতিক মহলের এমন গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল দুপুরে দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন- গুজবে কান দেবেন না। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের দলের সবাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছি। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ আছি আর সেটি সরকারের পছন্দ হচ্ছে না। মির্জা আলমগীর বলেন, আমরা সত্যিকারের একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু বর্তমানে যা চলছে, তাতে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। সেজন্য লড়াই করছেন খালেদা জিয়া। আমরা দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। ২০ দলীয় জোটের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০ দল আগেও ছিল, এখনো আছে। আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, আছি। কিন্তু জোট নিয়ে যেসব সংবাদ প্রচার হয়, তা তারা কোনো বক্তব্য দেননি। আমরা দলীয় ও জোটগতভাবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছি। দুই জোটের বাইরে থাকা দলগুলোকে নিয়ে বিএনপির বৃহত্তর ঐক্যের প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেন, এখনও সময় আসেনি। রাজনীতির প্রত্যেকটি জায়গার একটা সময় আছে। আমরা কথা বলছি, কথা চলছে। সবাইকে দেশের ও গণতন্ত্রের স্বার্থে একটা জায়গায় আসতে হবে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকার সময় আমাকে নিয়ে যেভাবে মনগড়া নিউজ করা হয়েছে, তাতে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। বিএনপি মহাসচিব হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর একটি পত্রিকায় ‘কে চালাবে বিএনপি’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর সমালোচনা করে মির্জা আলমগীর বলেন, এসব মনগড়া নিউজ জাতিকে বিভ্রান্ত করে। বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, যেখানে প্রতিটি নেতাকর্মী সবসময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে। তিনি বলেন, আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়েছি। যখন আমি হাসপাতালে ভর্তি, তখন আমাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে মনগড়া নিউজ। এসবের ফলে শুধু একটা দল বা ব্যক্তি নয়, গোটা জাতির ক্ষতি হয়। তাই আমি আহ্বান জানাব, যাতে এমন কোনো সংবাদ প্রচার না হয়, যাতে দেশের মানুষ বিভ্রান্ত হয়। বিএনপি মহাসচিব বলেন, সাংবাদিক ও সংবাদপত্র বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করবে, যাতে দেশ ও জাতি উপকৃত হতে পারে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে মনগড়া তথ্য প্রচার করে তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করা কখনও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা হতে পারে না। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের চেয়ারপারসন কারাগারে ‘অধিকার বঞ্চিত’ হচ্ছেন। খালেদা জিয়ার যে ন্যূনতম প্রাপ্য অধিকারগুলো তা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তার যখন ডিভিশন প্রাপ্তির কথা ছিল প্রথম কয়েক দিন তা দেয়া হয়নি। তাকে একটি পরিত্যক্ত নির্জন একটি কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। একটি সভ্য দেশে এমন কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। মির্জা আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের সাক্ষাৎ ও সেবা দেয়ার সুযোগ দিচ্ছে না সরকার। এক্ষেত্রে সরকারের আচরণ দেখে পরিষ্কার, তারা খালেদা জিয়ার সঠিক চিকিৎসা করতে দিতে চায় না। এর একটি মাত্র কারণ তারা তাকে ভয় পায়। কারণ তিনিই একমাত্র গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারেন এবং এই দুঃশাসনকে পরাজিত করতে পারেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের সমালোচনা করে মির্জা আলমগীর বলেন, দুদক সরকারের ইচ্ছাপূরণে কাজ করছে। সরকার যেভাবে চায়, তারা সেভাবে কাজ করছে। এখন আমাদের দলের আট নেতার চরিত্রহনন করতে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। তারা নাকি ১২৫ কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন করেছেন? আমি বলব, দুদকের এ অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও মনগড়া। আমাদের দলের যেসব নেতার নাম এসেছে তাদের মধ্যে এমন নেতাও আছেন যার ওই ব্যাংকে কোনো অ্যাকাউন্টই নেই। তিনি বলেন, সরকারের যারা দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যারা রাষ্ট্রের অর্থ পাচার করছে, ব্যাংক লুট করছে, শেয়ারবাজার ধ্বংস করেছে- তাদের বিষয়ে দুদক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এমন কি যারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন, তারা এখনো মন্ত্রী পদে বহাল আছেন। এদের বিরুদ্ধে দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয় না। তিনি বলেন, দুদকের একমাত্র কাজ হচ্ছে বিরোধী দলের মামলাগুলো দাঁড় করানো এবং তদন্তের নামে তাদের রাজনীতি থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা। কিন্তু কেন? গত দশ বছরে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, কয়জনের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত করেছে দুদক? অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাঝে-মাঝে মনে হয়, সত্যিই কি আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে? আমার তো মনে হয় আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে না। অন্য কেউ দেশ চালাচ্ছে। কারণ একটি রাজনৈতিক দল দেশ চালালে কখনো বিরোধী দলের সঙ্গে এমন আচরণ করে না; ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয় না। মির্জা আলমগীর বলেন, নিজের হাতে তৈরি করা যে সন্তানের জন্য লড়াই করেছে, যুদ্ধ করেছে; তাকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। কেয়ারটেকার জবাই করেছে, গণতন্ত্রকে জবাই করেছে। আসলে তারা কোথা থেকে কোথায় আসলো এগুলো আমাদের ভাবা উচিত। আমরা কেউ কিন্তু এগুলো নিয়ে চিন্তা করি না। গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচন সবসময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ। ইতিহাস যদি দেখেন, সবসময় নির্বাচনকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে নেয়া হয়েছিল। এজন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে অংশ নিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা জনগণের কাছে যেতে পারছি, আমাদের কথা তুলে ধরতে পারছি। গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ হবে- প্রত্যশার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সবসময় প্রত্যাশা করি একটি ভালো নির্বাচন হওয়া উচিত। কিন্তু কখনো সেটি হয় না। যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে তাদের কোনো ক্ষমতাই নেই। তারা ঠুটো জগন্নাথ। তাদের যে নির্দেশ করে তারা তাই করে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, নির্যাতনের মাত্রা যত বাড়বে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো তত বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও জনগণের মুক্তি একই সূত্রে গাঁথা। জনগণ যদি ভোট দিতে পারে তাহলে নৌকা খুঁঁজে পাওয়া যাবে না। গ?য়েশ্বর রায় ব?লে?ছেন, সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় খালেদা জিয়াকে বন্দি করেছে সুতরাং রাজনৈতিকভাবেই তাকে মুক্ত করা আমাদের প্রয়োজন। আমার মনে হয় আমরা বেশি দিন শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি নিয়ে আমাদের রাজনীতি সীমাবদ্ধ রাখবো না। সময় এসেছে আজকে এই সরকারের পতন নিশ্চিত করার। আর সরকারের পতন হলে খালেদা জিয়াও মুক্তি পাবেন, জনগণও মুক্তি পাবে। খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং জনগণের মুক্তি তাই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে বন্দি রাখা যাবে কিন্তু তিনি যে চেতনা লালন করেন, সেই চেতনার কোনো দিন মৃত্যু হবে না। আমরা যারা তার অনুসারি আছি, দীর্ঘদিন তার নেতৃত্বে পা?শে আ?ছি, আমাদের মধ্যেও সেই চেতনাবোধ অঙ্গিকার প্রতিশ্রুতি আছে। আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করছি, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। সেই গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যারা বাধা তারা গণতন্ত্রের শত্রু। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। সেই অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রে বা সেই অধিকার প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আমরা অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই; কিন্তু এটাকে আমরা আবার অতিক্রমও করি। গয়েশ্বর রায় বলেন, জনগণের সমর্থন আছে এ কারণে জনগণ যা চায় বিএনপি ও সেটাই চায়। জনগণ যা চায় সেটা খালেদা জিয়াও চায়। খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে বা দলের কোনো স্বার্থে লড়াই করছে না সেই কারণে জনগণও ঐক্যবদ্ধ আছে। তি?নি বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে এত হামলা মামলা তার পরও কিন্তু তাদের (আওয়ামী লীগের) একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়ার সৎ সাহস নেই। তা?দের অনেকেই হয়তো মনে করছেন বিএনপি শেষ কিন্তু বিএনপি শেষ হতে পারে না। আওয়ামী লীগের অত্যাচার নির্যাতন অগণতান্ত্রিক শক্তির নির্যাতন যত বাড়বে তত গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হবে। তাদের শক্তি আরও বাড়বে এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। গ?য়েশ্বর বলেন, কারাগারে বসে আমার সবচেয়ে যে বিষয়টি ভালো লেগেছে চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে আমাদের দলের যে ইউনিটি- এটাই সফলতার পূর্ব লক্ষণ। আমরা সফল হবো; কারণ আমাদের আন্দোলন বিএনপির স্বার্থে নয়। গয়েশ্বর রায় বলেন, আমরা জানি বর্তমান সরকার খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বের হতে দেবে না। আমি কথাটি স্পষ্ট বলছি সরকার আমাদের নেত্রীকে বের হতে দেবে না। কারণ এখানে আদালতের কিছু করার নেই। ইতিমধ্যে আদালত সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তিনি ব?লেন, আমি সবচেয়ে বেশি মনে করি খালেদা জিয়া বিএনপি চেয়ারপারসন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী এটাই তার বড় পরিচয় নয়। তার পরিচয় একটা, তিনি (খালেদা) একটা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান এবং তার যাত্রা শুরু গণতন্ত্রের আন্দোলন দিয়ে। এখনও তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করছেন। যেখানে তিনি কখনও আপস করেননি। সেই সঙ্গে এটাও বিশ্বাস করি ভবিষ্যতেও তিনি আপস করবেন না। সংজ্ঞত কারণেই তার এই আপসহীন মনোভাবের সঙ্গে বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী একই চেতনা নিয়ে তারা রাজনীতি করছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করছে। তার এই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য তিনি সাচ্চা জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক। গয়েশ্বর রায় বলেন, দেশের কোনো ক্ষয়ক্ষতি, দেশের স্বার্থ বিনষ্ট হোক এই বিষয়ের ওপর তিনি কখনই আপস করেননি। তিনি দেশটাকেই বড় করে দেখেছেন এবং কখনও কখনও তিনি বিএনপির স্বার্থ না দেখে দেশের স্বার্থটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সে কারণেই বলছি খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির একটা প্রতিষ্ঠান। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান বলেন, বিএনপির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খালেদা জিয়া ও গণতন্ত্রকে মুক্ত করা। অবরুদ্ধ মানবাধিকার যা ভূলণ্ঠিত হয়েছে, সেটি প্রতিষ্ঠিত করা। এক্ষেত্রে এক বিন্দুও আমরা পিছপা হবো না। হয় সফলতা, না হয় মৃত্যু। এর বাইরে আর কোনো রাস্তা নেই। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, সেলিমুজ্জামান সেলিম, শহীদুল ইসলাম বাবুল, আবদুস সালাম আজাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, তিন দিন অসুস্থ থাকার পর বৃহস্পতিবার দলীয় নিয়মিত কার্যক্রমে ফিরেছেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.