অসুস্থতার কারণে খালেদাকে আদালতে হাজির করা হয়নি

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার অসমাপ্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আগামী ২২শে এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন আদালত। একই সঙ্গে ওই দিন পর্যন্ত এ মামলার আসামি খালেদা জিয়ার জামিন বর্ধিতকরণের আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল শুনানি শেষে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান এ আদেশ দেন। অসুস্থতার কারণে গতকালও খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করা হয়নি বলে জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। এদিকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার পরবর্তী বিচারকাজ পরিচালনার জন্য আদালতে আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। তবে, ভিডিও কনফারেন্সের বিরোধিতা করে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আব্দুর রেজাক খান বলেছেন, দুদক আইনজীবীর এ ধরনের বক্তব্যের কোনো যৌক্তিকতা নেই এবং তা বাড়াবাড়ি। জিয়া   চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ রাজধানীর বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে চলছে। এর আগে  ২৮শে মার্চ খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করার কথা থাকলেও অসুস্থতার কারণে ওই তারিখে তাকে হাজির করা হয়নি। গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে ৫ বছর ও অন্য আসামিদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন একই আদালত। রায়ের পর থেকে খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে।
গতকাল সকাল থেকে বকশীবাজারের বিশেষ আদালত ও কারাগার এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আদালতের বাইরের বিভিন্ন সড়কে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের জানান, খালেদা জিয়া অসুস্থ তাই বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না। আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতের উদ্দেশে বলেন, আজ (গতকাল) এই মামলায় যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য ধার্য আছে। আদালতে দুজন আসামি (জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খান) উপস্থিত আছেন। খালেদা জিয়া অসুস্থ। তিনি আথ্রাইটিসে ভুগছেন। তাই, তাকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করাতে চান। খালেদা জিয়াকে চাহিদা মোতাবেক গৃহকর্মী দেয়া হয়েছে। তাঁকে ব্যক্তিগত চিকিৎসক দেয়ার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন আছে। মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, খালেদা জিয়া যেহেতু অসুস্থ, তাকে আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না, তাই আমরা এই মামলার বিচারকাজ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরিচালনা করতে চাই। তিনি বলেন, ভারতের লালু প্রসাদ যাদবের (বিহার রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) মামলার বিচারকাজও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী আমাদেরও এ সুযোগ রয়েছে। আগামী তারিখে এ বিষয়ে আদালতে আবেদন করবো। 
এ সময় খালেদার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের একটি পিটিশন রয়েছে। তাছাড়া কাস্টডি ওয়ারেন্ট আমরা এখনো দেখিনি।
এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আব্দুর রেজাক খান দুদক আইনজীবীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, এই আদালত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী চলে। আদালত কীভাবে চলবে, কীভাবে পরিচালিত হবে সেজন্য আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রয়োজন। ভিডিও  কনফারেন্স, এটা সেটা-এ ধরনের বক্তব্য বাড়াবাড়ি। এসব বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য এক মাস সময়ের আবেদন করেন আব্দুর রেজাক খান। শুনানিতে দুদকের আইনজীবী বলেন, আমার কাছে তথ্য আছে যে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ নন। তিনি তার পুরনো অসুখেই ভুগছেন। মেডিকেল বোর্ড তাকে ওষুধ দিয়েছে। কিন্তু তিনি সে ওষুধ গ্রহণ করছেন না। এ পর্যায়ে আব্দুর রেজাক খান বলেন, আপনি যেটি জানেন না সেটি নিয়ে কথা বলবেন না।
মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আমি এই মামলার পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) আমাকে কথা বলতেই হবে।
আব্দুর রেজাক খান বলেন, আপনি দুদকের পিপি, স্টেটের পিপি নন। এ পর্যায়ে আদালত এ মামলার অসমাপ্ত যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য আগামী ২২শে এপ্রিল দিন ধার্য করেন। একই সঙ্গে ওই ধার্য তারিখ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিন বর্ধিত করেন। খালেদা জিয়ার পক্ষে আরো উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার, মো. আমিনুল ইসলাম, জাকির হোসেন ভুঁইয়া। আদালত থেকে বেরিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আব্দুর রেজাক খান উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আজ (গতকাল) আদালতে খালেদা জিয়াকে উপস্থিত করা হয়নি। কাস্টডি ওয়ারেন্টে লেখা আছে তিনি অসুস্থ। আব্দুর রেজাক খান বলেন, দুদকের পিপি বলেছেন, যেহেতু খালেদা জিয়া অসুস্থ, তাই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই মামলার পরবর্তী বিচারকাজ চলতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। তিনি বলেন, আদালতের কথায় মামলার বিচারকাজ চলবে, দুদকের পিপির কথায় নয়। আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে যে বেগম খালেদা জিয়ার মামলা কোথায় হবে। আব্দুর রেজাক খান বলেন, সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের আইন আদালত চলছে। আদালতের কার্যক্রম যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে। খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত বিষয়ে দুদকের আইনজীবীর বক্তব্যের সমালোচনা করে আব্দুর রেজাক খান বলেন, দুদকের পিপি সরকারের মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দিতে পারেন না। তার কথা আমলে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যা কিছু বক্তব্য আসবে জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আসবে। চিকিৎসা গ্রহণ করা না করা এগুলো জেল কর্তৃপক্ষের প্রশাসনের ব্যাপার। এ বিষয়ে আদালত কিংবা পিপি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। খালেদা জিয়া ওষুধ খাচ্ছেন না- এ ধরনের বক্তব্য তার (দুদকের আইনজীবী) মনগড়া। এটি অতি উৎসাহী বক্তব্য।  
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছেন তিনি (খালেদা জিয়া) অসুস্থ। কারণ তিনি আথ্রাইটিসে ভুগছেন। এটি তার পুরনো রোগ। তার নতুন কোনো রোগ নেই। তিনি পুরনো রোগেই আক্রান্ত। মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ড তাকে ওষুধ দিয়েছে। কিন্তু তিনি সেই ওষুধ গ্রহণ করছেন না। তিনি ব্যক্তিগত চিকিৎসক চেয়েছেন। হয়তো ব্যক্তিগত চিকিৎসক পেয়ে যাবেন। মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, যেহেতু খালেদা জিয়া আথ্রাইটিসে ভুগছেন এবং তিনি চলাফেরায় অক্ষম, সমস্যা হচ্ছে। সেই কারণে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় কি না আদালতে সেটি বলেছি। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতে লালু প্রসাদ যাদবের মামলার বিচারকাজ ও রায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হয়েছে। তাই দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা মনে করি সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই মামলা পরিচালনা করা যায় কি না। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উপস্থিত হয়ে তার (খালেদা জিয়া) আইনজীবীরা মামলা পরিচালনা করতে পারেন। এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা আছে বলে আমার জানা নেই।
মামলার বিবরণে জানা যায়, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে আসা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১০ সালের ৮ই আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলা করে  দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ১৬ই জানুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ চারজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশিদ। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক একান্ত রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

No comments

Powered by Blogger.