কিংবদন্তির বিদায় by মহিবুল হাসান

কাকতালীয়ই বলতে হয়। এক কিংবদন্তি পদার্থবিদ গ্যালিলিও গ্যালিলির মৃত্যুর ঠিক তিনশ’ বছর পর ১৯৪২ সালের ৪ জানুয়ারি জন্ম হয়েছিল তার। আর মৃত্যু হল আরেক কিংবদন্তি পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিনের দিন- ১৪ মার্চ। তিনি নিজেও আরেক কিংবদন্তি পদার্থবিদ- স্টিফেন হকিং। যৌবনেই মটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ায় চিকিৎসকরা বলে দিয়েছিলেন, আর মাত্র দু’বছর আয়ু। কিন্তু তিনি বেঁচে রইলেন। বেঁচে রইলেন বলেই বিশ্ব পেল এক মহান বিজ্ঞানী। তাকে বিশ্বের সমকালীন তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের দুটি অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরাজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিংগুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্ব ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্তে প্রয়োগ করে দেখান যে, ব্ল্যাক হোল থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকরণ এখন হকিং বিকিরণ নামে অভিহিত। আলবার্ট আইনস্টাইনের পর আর কোনো বিজ্ঞানী বিশ্বজোড়া এত জনপ্রিয়তা পাননি। তার জীবন নিয়ে সিনেমা পর্যন্ত হয়েছে। তবে যে বই তাকে জনপ্রিয়তার শিখরে তুলেছিল তা হল ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। বইটির জনপ্রিয়তা অতীতের সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত এ বইয়ের শুধু ইংরেজি ভার্সনই বিক্রি হয়েছে কোটির ওপর। টানা পাঁচ বছরেরও বেশি লন্ডন সানডে টাইমসের বেস্টসেলার তালিকায় থেকেছে এ বই। অনুবাদ হয়েছে বাংলাসহ বহু ভাষায়। বিজ্ঞানে হকিংয়ের আগ্রহ ছিল সহজাত। বাবার ইচ্ছা ছিল হকিং যেন তার মতো ডাক্তার হয়। কিন্তু হকিং গণিত পড়ার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। তবে যেহেতু সেখানে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সেজন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়া শুরু করেন। সে সময় তার আগ্রহের বিষয় ছিল তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। তিনি কেমব্রিজে আসার পরপরই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন। এ কারণে তার দেহের প্রায় পুরো মাংসপেশী ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসে। কেমব্রিজে প্রথম দুই বছর তার কাজ তেমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল না। কিন্তু রোগের প্রকোপ কিছুটা কমলে হকিং তার সুপারভাইজার ডেনিশ উইলিয়ামের সাহায্য নিয়ে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের কাজে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯৭৪ সালে হকিং রয়াল সোসাইটির অন্যতম কনিষ্ঠ ফেলো নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর অবসর নিলেও তিনি কেমব্রিজের গনভিলি ও কেয়াস কলেজের ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। শারীরিকভাবে ভীষণরকম অচল হওয়া সত্ত্বেও বহু বছর যাবৎ তিনি তার গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে গেছেন। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অবসান ঘটল একটি বহুল আলোচিত অধ্যায়ের। তবে পৃথিবী তাকে মনে রাখবে বিজ্ঞান গবেষণায় তার অসামান্য অবদানের জন্য।
মহিবুল হাসান : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়াদির লেখক

No comments

Powered by Blogger.