কী হবে ট্রাম্প-কিম আলোচনায় by রাশিদুল ইসলাম

উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন পারমানবিক প্রস্তুতি ত্যাগ তো দূরের কথা প্রয়োজনে হামলার জবাবে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে আঘাতের কথা বলেছিলেন। কূটনৈতিক সাফল্যের মধ্যে দিয়েই কি তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে আগামী মে মাসে আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন ? গত বছর অন্তত ২৫টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছেন, হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষা করেছেন। সেই কিমের হঠাৎ ট্রাম্পের সাথে আলোচনায় সম্মতি ওয়াশিংটনে সাড়া ফেলেছে। কারণ দুই মাস আগেও কোরিয় উপদ্বীপে শক্তির মহড়া প্রদর্শন করেছে একাধিক পক্ষ। এক অনিবার্য সামরিক সংঘর্ষ থেকে আলোচনার টেবিলে বসবেন ট্রাম্প ও কিম, সাড়া এ কারণেও। তবে ওই বৈঠকের ফলাফল কি হতে পারে তা আঁচ করা খুবই কঠিন কারণ উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক উদ্যোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে দীর্ঘ দিন ধরেই আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা এখনো ফলদায়ক হয়ে ওঠেনি। পারমানবিক প্রস্তুতি থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এখনো দেয়নি পিয়ংইয়ং। বরং সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিকূল নীতি অনুসরণ করে আসছে উত্তর কোরিয়া। কিম শর্ত দিয়েছেন তার দেশের ওপর থেকে আগে হামলার হুমকি প্রত্যাহার করে কোরিয় উপদ্বীপে নিরাপদ অঞ্চলের নিশ্চয়তা দিতে হবে। একই সাথে উত্তর কোরিয়া দীর্ঘ দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রকে তার নীতির কারণে দায়ী করে পারমানবিক অস্ত্রের যৌক্তিকতা দাবি করে আসছে। ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরওপ করে আসছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে উত্তর কোরিয়া। অপরদিকে চীন ও রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়ে আসছে উত্তর কোরিয়াকে বাধ্য করতে যাতে দেশটি পারমানবিক অস্ত্র তৈরি থেকে সরে দাঁড়ায়। সিওলে শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিমের বোন কিম ইয়ো জং’এর অংশ নেয়ার মধ্যে দিয়ে পিয়ংইয়ং’এ দক্ষিণ কোরিয়ার যে প্রতিনিধিদল আসেন তার সাথে বৈঠকে বসেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট কিম। সর্বশেষ উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তা মি. চুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আশ্বস্ত করেছেন, উত্তর কোরিয়া কোনো রকম ক্ষেপণাস্ত্র বা পরমাণু পরীক্ষা থেকে বিরত থাকবে। এসব কারণ ছাড়াও ওয়াশিংটনে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে যে ট্রাম্প ও কিমের বৈঠকের আগে ও পরে পারস্পরিক স্বচ্ছতা থাকবে কি না তা নিয়েও। কারণ এর আগে কোরিয়ার সাথে অনেক চুক্তি পর্যাপ্ত যাচাইয়ের অভাবে কোনো কাজে আসেনি। উত্তর কোরিয়ার ওপর অবরোধ অব্যাহত রেখে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় কতটা সফলতা নিয়ে আসতে পারবে সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ পিয়ংইয়ংকে নতুন ধরনের স্বার্থের প্রবৃত্তির বৃত্তে আনতে না পারলে ট্রাম্প প্রশাসন সঙ্কটকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে কতটা নিতে পারবে সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আলোচনা ভেস্তে গেলে ফের কিম ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুতি আরও জোরদার করবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়? ট্রাম্পের সাথে কিমের বৈঠকে বসতে রাজি হওয়ার বিষয় নিয়ে একারণেই ওয়াশিংটেনে এত সাড়া পড়েছে। বলা হয়েছে যত শিগগিরই সম্ভব কিম ট্রাম্পের সাথে আলোচনায় বসতে চান। ট্রাম্প আগাম মে মাসের কথা বলেছেন। এর আগে আগামী এপ্রিলে দুই কোরিয়ার নেতার আলোচনায় বসার সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন তিনি কিমের সাথে আলোচনায় বসতে পারলে সম্মানিত হবেন। কিমের একটি চিঠিও ট্রাম্পের হাতে ওয়াশিংটনে পৌঁছে দিয়েছে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধি দলটি। এর আগে কখনও যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতারা কোনো আলোচনায় বসেননি। তাই ট্রাম্প ও কিমের বৈঠকের পর তা হয়ে উঠবে ঐতিহাসিক।
কিন্তু তার আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কোরিয় উপদ্বীপে মার্কিন সামরিক মহড়া বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা কার্যকর করে তুলতে হবে। এখনো স্পষ্ট নয় ট্রাম্পের সাথে কিমের বৈঠক কোথায় হবে। ট্রাম্প কিমকে আঘাত করে ‘ম্যাডম্যান’ অভিহিত করে বলেছিলেন যে তার জনগণকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না। ‘লিটিল রকেট ম্যান’ বলেও অভিহিত করেছিলেন। বলেছিলেন কিমের চাইতে তার অস্ত্রটি বড়ও যুৎসইভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন যিনি উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে এ বৈঠকের প্রস্তাব পেয়েছেন। ট্রাম্প বরং তা গ্রহণ করেছেন। সিএনএন’এর বিশ্লেষণে প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্প কি ফাঁদে পা দিচ্ছেন। নাকি মার্কিন অবরোধ কোনো কাজে আসছে না বলেই ট্রাম্প কিমের সাথে বৈঠকে বসতে চাচ্ছেন। ২০০০ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখনকার উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং (দ্বিতীয়)’এর সাথে প্রস্তাবিত বৈঠকে বসার আগে বলেছিলেন, ‘ যতক্ষণ না বৈঠকে বসার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ আমি পিয়ংইয়ং যাচ্ছি না। প্রেসিডেন্ট বুশ উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনায় তার দেশসহ দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, রাশিয়া ও চীনকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিউবা সফর করে প্রেসিডেন্ট রাহুল ক্যাস্ট্রো ও টেলিফোনে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সাথে কথা বললেও উত্তর কোরিয়া সফর বা কিমের সাথে কথা বলতে রাজি হননি। ওবামা বলেছিলেন, উস্কানি মূলক আচরণ রয়েছে কিমের, তাকে আমরা প্রশ্রয় দিতে পারি না। উত্তর কোরিয়ার ওপর ধারাবাহিক অবরোধ, কোরিয় উপদ্বীপে মার্কিন সামরিক শক্তি বৃদ্ধিসহ নানা চাপে গত ৭০ বছর ধরে এ দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়ত একটা বৈঠকে ফয়সালার দিকে আগাতেও পারে। উত্তর কোরিয়া মার্কিন হুমকির জন্যেই পারমানবিক প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হয়েছে। দেশটি আলোচনায় সব সময় বসতে চাইলেও মার্কিন প্রশাসন কখনও তাতে সায় দেয়নি। ফলে চীন ও রাশিয়ার সাহায্য নিয়েই দেশটি হুমকির মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতিতে উত্তর কোরিয়া নিশ্চুপ থাকেনি। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট জায়ে ইন মুন নির্বাচিত হওয়ার পর উত্তর কোরিয়ার সাথে উত্তেজনা প্রশমনে আলোচনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছেন। এর ফলে দুই কোরিয়ার মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি চীন উত্তর কোরিয়াকে পারমানবিক প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়টিতে পিছু হটতে চাপ সৃষ্টি করেছে, ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্টকে সে ধরনের অনুরোধই করেছিলেন। যদি ট্রাম্প ও কিমের বৈঠক সফল হয় তাহলে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এক নতুন ধারার সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। রাশিয়ার প্রচেষ্টাও এক্ষেত্রে বিশ্ব সঙ্কট মোকাবেলায় আরেক অধ্যায় সৃষ্টি করতে পারে। ট্রাম্প কঠিন কথা বলতে ভালোবাসেন, কিম ভালোবাসেন কার্যকর করতে। কিম তার ভাইকে ছাড়েননি। ট্রাম্প কিমের মতই শক্তিশালী নেতাকে পছন্দ করেন। ট্রাম্প পুতিন, এরদোগান, দুতার্তে এবং শি জিন পি কে পছন্দ করেন। অপছন্দ করেন এ্যাঙ্গেলা মার্কেল বা থেরেসা মে’কে। ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি করে পথপরিক্রমা তৈরি করতে পারেন হয়ত ট্রাম্প শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েও যেতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.