বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা কী by রাইসুল সৌরভ

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিকটবর্তী একটি খেলার মাঠে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনা ১৯৮৪ সালের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের বেসামরিক যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনা বলে বিবেচিত হচ্ছে। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছেন এবং যে স্বল্পসংখ্যক ভাগ্যবান প্রাণে বেঁচে গেছেন তাদের অধিকাংশই মারাত্মক আহত অবস্থায় নেপালের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত স্বভাবতই জটিল প্রক্রিয়া এবং ঠিক কী কারণে এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হল তা যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত বলা যাবে না। এ দুর্ঘটনার পেছনে পাইলট, ইউএস-বাংলা বিমান কর্তৃপক্ষ, ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, বিমানটির মূল তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানসহ এক বা একাধিক পক্ষ দায়ী থাকতে পারে। যদিও উড়োজাহাজ পরিবহন ব্যবস্থায় বহু পক্ষ জড়িত থাকে এবং দুর্ঘটনার পেছনে প্রত্যেক পক্ষের স্বতন্ত্র দায় থাকতে পারে; তবে সে দায় নির্ধারণ করাও বেশ জটিল প্রক্রিয়া। তথাপি কঠোর দায়-নীতির আওতায় এ ঘটনায় যেই জড়িত থাকুক না কেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার জন্য সাধারণত বিমান পরিবহন সংস্থাকেই আন্তর্জাতিকভাবে দায়ী করা হয়ে থাকে। উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা অন্য আট-দশটা দুর্ঘটনা থেকে ভিন্ন। কারণ এর রয়েছে বিভিন্ন মাত্রা, যেমন অন বোর্ড দুর্ঘটনা, অফ বোর্ড দুর্ঘটনা, লাগেজ হারিয়ে যাওয়া, বিমান দুর্ঘটনার কারণে কারও সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এ ছাড়া ফ্লাইটটি অভ্যন্তরীণ নাকি আন্তর্জাতিক ছিল ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ক্ষতিপূরণের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হয়।
তবে নেপাল ট্রাজেডির মতো সরাসরি বিমানাভ্যন্তরে থাকাকালীন দুর্ঘটনার কারণে কোনো যাত্রী আহত বা নিহত হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার বিমান পরিবহন কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রাখে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, টিকিট ক্রয় করার সময় বিমান পরিবহন সংস্থা বা ট্রাভেল এজেন্ট কর্তৃক প্রদত্ত টিকিটে যে শর্তই উল্লেখ থাকুক না কেন, দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে তা কাউকে বঞ্চিত করতে পারে না। ১৯৯৯ সালের আগে পৃথিবীব্যাপী বেসামরিক বিমান পরিবহন ওয়ারশ কনভেনশন দ্বারা পরিচালিত হতো। কিন্তু ১৯৯৯ সালের পর থেকে মন্ট্রিল কনভেনশনের মাধ্যমে মৃত্যু, জখম, ব্যাগ হারানো, কার্গোতে বিলম্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এবং যাত্রীদের ওয়ারশ কনভেনশনের চেয়ে অধিক সুরক্ষা ও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা হয়েছে। মন্ট্রিল কনভেনশনে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে স্বাক্ষর করলেও এ কনভেনশনে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দিতে এখনও পর্যন্ত নতুন করে কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এ কনভেনশনের ১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিমানে মৃত্যু বা শারীরিক আঘাতের জন্য ক্যারিয়ারকে শুধু তখনই দায়ী করা যাবে যদি দুর্ঘটনাটি বিমান চলার সময় বা বিমানে আরোহণ বা অবতরণ করার সময় সংঘটিত হয়। দুর্ঘটনা বলতে এ কনভেনশনে যাত্রীর আওতাবহির্ভূত কোনো অপ্রত্যাশিত বা অস্বাভাবিক ঘটনা বোঝাবে (এয়ার ফ্রান্স বনাম সেক, ১৯৮৫, ৪৭০ ইউএস ৩৯২)। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইউএস-বাংলার দুর্ঘটনাটি যাত্রীদের তরফ থেকে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই বিমানাভ্যন্তরে সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং মন্ট্রিল কনভেনশনের অধীনে তারা সবাই ক্ষতিপূরণ দাবি করার অধিকার রাখেন। উল্লিখিত কনভেনশনের ২১ অনুচ্ছেদ অনুসারে, মৃত্যু অথবা প্রতি যাত্রীর শারীরিক জখমের দরুন বিমানের দায়িত্ব সর্বোচ্চ ১, ১৩, ১০০ এসডিআর পর্যন্ত। এসডিআরের মান হিসাব বিভিন্ন দেশের ভোক্তা মূল্যসূচক বৃদ্ধি বা হ্রাসের বার্ষিক হারের গড় পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নির্ধারণ করে এবং প্রতি পাঁচ বছর পরপর এটি পুনর্নির্ধারণ করে। যার ফলে একই বিমান দুর্ঘটনায় বিভিন্ন দেশের নাগরিক বিভিন্ন পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন।
মন্ট্রিল কনভেনশন অনুযায়ী আইএমএফের সদস্য নয়, এমন রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিপূরণের সীমা নির্ধারণ করা আছে। তাই মন্ট্রিয়েল কনভেনশনের অধীন এ দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত প্রত্যেক বাংলাদেশি বা তার পরিবার সর্বোচ্চ ১,৭৪,০০০ মার্কিন ডলার (যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি টাকারও বেশি) পেতে পারেন; যদিও জীবনের মূল্য টাকার অংকে হিসাব করা কারও দ্বারাই সম্ভব নয়। উপরন্তু, দুর্ঘটনার শিকার কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবার এ পরিমাণের চেয়ে বেশিও দাবি করতে পারেন, যদি তিনি বা তার পরিবার মনে করেন তাদের যে ক্ষতির পরিমাণ তা এ অংকের ক্ষতিপূরণে যথেষ্ট নয়। তবে সেক্ষেত্রে বিমান পরিবহন সংস্থা অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে আদালতে যেতে পারে এবং তারা যদি প্রমাণ করতে পারে যে মৃত্যু বা আহত হওয়ার কারণ বিমান সংস্থা বা তাদের কর্মী বা এজেন্ট ব্যতীত তৃতীয় কোনো ব্যক্তির অবহেলা বা অন্য কোনো ভুল; তবে সেক্ষেত্রে অধিক পরিমাণটুকু বিমান সংস্থা না দিয়ে সেই তৃতীয় ব্যক্তির ওপর সে দায়ভার বর্তাবে। একটি বিমান দুর্ঘটনা থেকে আঘাতপ্রাপ্ত জীবিত ব্যক্তি দুই ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হন : এক. আর্থিক এবং দুই. মানসিক। চিকিৎসা খরচ, আয় হ্রাস, কোনো অঙ্গের ক্ষতি (যদি থাকে) হল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতি আর মানসিক ক্ষতি হল সেই দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট মানসিক বেদনা ও যন্ত্রণার বোঝা, কখনও কখনও যা আজীবনও বয়ে বেড়ানো লাগতে পারে। তবে কোনো যাত্রী দুর্ঘটনার কারণে মেডিকেল স্বীকৃত মানসিক কোনো সমস্যায় ভুগছেন কিনা তা নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। উপরন্তু, কোনো শারীরিক ক্ষতি ছাড়া কেবল মানসিক অসুস্থতার জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়ার নজির বিরল (মরিস বনাম কেএমএল, ২০০২, ইউকেএইচএল ৭। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও একইভাবে তাদের নিকটজন হারানোর ব্যথা ও দুর্ভোগের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন। মন্ট্রিল কনভেনশনের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক আহত ব্যক্তি দুর্ঘটনাস্থল নির্বিশেষে তার দেশে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী। তাই ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনাটি নেপালে ঘটায় ক্ষতিপূরণ পেতে কারও কোনো অসুবিধা হবে না। উপরন্তু, এয়ার ক্যারিয়ারের দায়িত্ব এক্ষেত্রে কঠোর দায়বদ্ধতার নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে; তাই যাত্রীকে বিমানের কোনো অবহেলা বা অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।
তবে মনে রাখতে হবে, মন্ট্রিল কনভেনশন অনুসারে ব্যক্তিগত আঘাতের ক্ষতিপূরণ দাবির সর্বোচ্চ সময়সীমা দুর্ঘটনার দুই বছর পর্যন্ত। ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পারছি, সেদিনের সব যাত্রীর (৬৭ জন) বীমা করা হয়েছিল এবং ইউএস-বাংলা বিমান কর্তৃপক্ষ সব ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের (যারা মৃত) পরিবারকে চিকিৎসা খরচসহ প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেবে। তবে মন্ট্রিল কনভেনশন কার্যকর করা এবং বিমান যাত্রী, লাগেজ ও পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের বিমান পরিবহন নিরাপত্তাবিষয়ক দ্রুত একটি আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। যদিও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ গত বছরের শেষ নাগাদ এ সংক্রান্ত আধুনিক একটি আইন প্রণয়ন করার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ পাঠিয়েছিল, তবে তা কার্যকর করার জন্য সরকারের তরফ থেকে এখনও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সরকারকে তাই এখন নিশ্চিত করতে হবে যে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এবং তাদের পরিবারগুলো আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাবে। যদিও ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার ক্ষতি কোনোভাবেই আর পূরণ করা সম্ভব নয়, তথাপি আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা নির্ধারিত বাধ্যবাধকতা এড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই এবং ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ দ্বারা সেই দায়বদ্ধতা কঠোরভাবে অনুসরণ করার জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় নজরদারি, এমনকি প্রয়োজন হলে হস্তক্ষেপও কাম্য।
রাইসুল সৌরভ: আইনজীবী; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং সমতা ও অধিকার শ্রমিক; যুক্তরাজ্যের স্টারলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক জ্বালানি আইন ও নীতিতে
স্নাতকোত্তর
raisul.sourav@outlook.com

No comments

Powered by Blogger.