মানবজাতিকে যে বার্তা দিয়ে গেলেন হকিং by জি. মুনীর

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলে বিবেচিত স্টিফেন উইলিয়াম হকিং গত ১৪ মার্চ, ২০১৮ মারা গেছেন। তার জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে। তার ৭৬ বছরের জীবনকালের ৫২টি বছরই ছিল হুইল চেয়ারে আটকে থাকা এক জীবন। একজন চরম প্রতিবন্ধী মানুষ হয়েও এই হুইল চেয়ারে বসেই তিনি বিরামহীনভাবে বিজ্ঞান গবেষণা করে গেছেন আমৃত্যু। কারণ, মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তিনি আক্রান্ত হন মোটর নিউরন রোগে।
চিকিৎসাবিদ্যার ভাষায় এ রোগের নাম; অ্যামিওট্রপিক ল্যাটারেল স্কেরোসিস, সংক্ষেপে এএলএস। এ রোগে পড়ে তিনি তার চলার শক্তি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ ধরনের রোগ থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। বলা হয়, এটি আরোগ্যাতীত এক রোগ। স্বল্প সময়ে মৃত্যুই যেন তাদের জন্য অবধারিত। এ রোগ ধরা পড়ার পর তার চিকিৎসকেরাও বলছিলেন, তিনি বড়জোর আর দুই বছর বাঁচবেন; কিন্তু সবাইকে অনেকটা অবাক করে দিয়ে বেঁচেছিলেন আরো ৫২ বছর। আর এই সময়টুকু তার কাটে বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক গবেষণায়। এই রোগ সম্পর্কে তিনি একসময় তার এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমি আর বাঁচব না, এমন সম্ভাবনা নিয়ে বেঁচে আছি ৪৯ বছর ধরে। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। আমি মরার জন্যও তাড়াহুড়ো করছি না।’ এই রোগ নিয়ে এত দীর্ঘ সময় তার বেঁচে থাকার পেছনে রহস্যটা কী? এ প্রশ্নের জবাবে এই রোগ বিষয়ে জনৈক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘এর আংশিক কারণ তিনি পেয়েছেন ভালো স্বাস্থ্যসেবা, আর প্রধান কারণ তার সৌভাগ্য। নিশ্চিতভাবে তিনি একজন ব্যতিক্রমী মানুষ।’ সুখের কথা, তিনি হাঁটাচলার শক্তি হারানোর পাশাপাশি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললেও অন্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারতেন একটি ‘স্পিচ জেনারেটিং ডিভাইসে’র মাধ্যমে। প্রথম দিকে তিনি এই ডিভাইসটি চালাতেন তার হাতে থাকা একটি সুইচ দিয়ে। পরবর্তী সময়ে তাকে তা চালাতে হতো একপাশের গালের মাসপেশি দিয়ে। তিনি ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, পৃথিবীর সৃষ্টি ও বিবর্তন সম্পর্কিত তাত্ত্বিক (কসমোলজিস্ট), লেখক এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল কসমোলজি’র গবেষণা পরিচালক। তার বৈজ্ঞানিক কর্মসাধনার মধ্যে রয়েছে রোজার পেনরোজ সহযোগে গ্র্যাভিটেশনাল সিঙ্গুলারিটি থিওরেমের ওপর গবেষণা। তার এই গবেষণা চলে জেনারেল রিলেটিভিটির কাঠামোর আওতায়। তার ব্যাপক গবেষণা রয়েছে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণবিবর সম্পর্কে। তিনি তাত্ত্বিকভাবে ঘোষণা করেন, ব্ল্যাক হোল থেকেও বিকিরণ ঘটে। কখনো কখনো এই বিকিরণকে ‘হকিং রেডিয়েশন’ নামেও অভিহিত করা হয়। তিনিই প্রথম কসমোলজি থিওরি ব্যাখ্যা করেন জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম মেকানিকসকে একসাথে করে। তিনি কোয়ান্টাম মেকানিকসের ‘ম্যানি ওয়ার্ল্ড ইন্টারপ্রিটেশনের’ প্রবল সমর্থক ছিলেন।
তার বড় মাপের আবিষ্কারটি হচ্ছে বিগ ব্যাং সম্পর্কিত। তিনি আবিষ্কার করেন, বিং ব্যাংয়ের শুরু সিঙ্গুলারিটি থেকে। অর্থাৎ এটি ছিল উল্টো আকারের এক ব্ল্যাক হোল। তিনিই জানান, ব্ল্যাক হোলগুলো পুরোপুরি ব্ল্যাক নয়। এগুলোও শক্তি বিকিরণ করে এবং একসময় তা বাষ্পীভূত হয়ে উবে যায়। তিনি আরো আবিষ্কার করেন, প্রথম দিকে মহাবিশ্বে কোয়ান্টাম এনার্জির ওঠানামা করার কারণেই হয়তো আজকের দিনে আমরা গ্যালাক্সির ক্লাম্পিং প্রত্যক্ষ করি। হকিং ছিলেন রয়েল সোসাইটি অব আর্টসের একজন ফেলো ও পন্টিফিক্যাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য। তিনি পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’। ২০০২ সালে বিবিসি জরিপে তাকে ২৫তম স্থান দেয়া হয় ‘১০০ গ্রেটেস্ট ব্রাইটনস’-এর তালিকায়। ১৯৭৯-২০০৯ সময়ে তিনি ছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লুকাসিয়ান প্রফেসর অব ম্যাথেমেথিকস’। তার পপুলার সায়েন্স সম্পর্কিত কাজগুলো বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পায়। এসব কাজে তিনি সাধারণ কসমোলজি বিষয়ে তার নিজস্ব তত্ত্বগুলো আলোচনা করেন। তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লিখে গেছেন। এর মধ্যে আছে : ব্ল্যাক হোল অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার এসেইজ, অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম, অ্যা ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম (স্টিফেন হকিং ও মোলদিনও), দ্য ড্রিম দেট দ্য স্টাফ ইজ মেইড অব, জর্জ অ্যান্ড দ্য বিং ব্যাং, জর্জ অ্যান্ড দ্য ব্লু মুন, জর্জ অ্যান্ড দ্য আনব্রেকেবল কোড, জর্জেস কসমিক ট্রেজার হান্ট, জর্জেস সিক্রেট কী টু দ্য ইউনিভার্স, গড ক্রিয়েটেড দ্য ইন্টিজার্স, দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন, দ্য লার্জ স্কেল স্ট্রাকচার অব স্পেস-টাইম, মাই ব্রিফ হিস্ট্রি, দ্য ন্যাচার অব স্পেস অ্যান্ড টাইম, অন দ্য শোল্ডার অব জায়ান্টস, দ্য ইউনিভার্স ইন অ্যা নাটশেল, ...। এর মধ্যে কয়েকটি শিশুতোষ বিজ্ঞানের বইও রয়েছে, যেগুলো হকিং তার কন্যা লুসি হকিংয়ের সাথে নিয়ে লিখেছেন। হকিংয়ের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। এটি একটি রেকর্ড-ভাঙা সর্বাধিক বিক্রীত বই- রেকর্ড-ব্রেকিং বেস্টসেলিং বুক। ব্রিটিশ সানডে-টইমসের বেস্ট-সেলার লিস্টে একটানা ২৩৭ সপ্তাহ ছিল এই বইটির নাম। এই বইটির ভূমিকা লিখেছেন আমেরিকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কসমোলজিস্ট, জ্যোতির্পদার্থবিদ, জ্যোতির্প্রাণিবিজ্ঞানী, লেখক, বিজ্ঞান জনপ্রিয় করে তোলার কারিগর, জনপ্রিয় বিজ্ঞানবক্তা কার্ল সাগান। বইটির ভূমিকাংশের এক জায়গায় সাগান উল্লেখ করেছেন- এই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো পরিপূর্ণ ‘গড’ শব্দটি দিয়ে। আইনস্টাইনের একটি বিখ্যাত প্রশ্ন ছিল- এই মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে গডের কি কোনো পছন্দ ছিল? হকিং সে প্রশ্নেরই জবাব খুঁজেছেন। আসলে এই বইটিতে হকিং আলোচনা করেছেন বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে ব্ল্যাক হোল পর্যন্ত বিষয়াবলি। এতে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন : সময়ের কি কোনো শুরু ছিল? সময় কি পেছনে ফিরে যেতে পারে? মহাবিশ্ব কি সসীম? এর কি কোনো সীমানা আছে? এসবের ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত মাস্টারপিস হিসেবে বিবেচিত এই বইয়ে। বইটি শুরু নিউটন থেকে আইনস্টাইন পর্যন্ত দেয়া বিখ্যাত সব তত্ত্বের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে। বইটির উপসংহারে তিনি কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন : আমরা এক হতভম্বকর দুনিয়ায় বসবাস করছি। আমাদের চার পাশে যা দেখছি, সে ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে এবং নিজেদের কাছে প্রশ্ন রাখতে হবে : এই মহাবিশ্বের প্রকৃতিটা কী? এই মহাবিশ্বে আমাদের স্থান কোথায়? এই মহাবিশ্ব ও আমরা কোথা থেকে এলাম?
এই মহাবিশ্বটাইবা কেন এমন? ‘মাই ব্রিফ হিস্ট্রি’ বইটিতে বিবরণ রয়েছে স্টিফেন হকিংয়ের অভাবনীয় ব্যক্তিগত অভিযাত্রার- সেই যুদ্ধোত্তর লন্ডন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা পর্যন্ত সময়ের। ছোট্ট এই বইটিতে রয়েছে তার দুর্লভ কিছু ছবি। এই বইটি পাঠকদের নিয়ে যাবে সেই অনুসন্ধিৎসু মনের স্কুল বালকের জীবনে, যাকে তার শ্রেণিবন্ধুরা নাম দিয়েছিল আইনস্টাইন। এই বইটি পাঠকদের জানাবে সেই জোকস্টারের কথা, যিনি সহকর্মীদের সাথে বাজি ধরেছিলেন ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের ব্যাপারে। এই বইটি পাঠকদের নিয়ে যাবে এক তরুণ স্বামীর জীবনে এবং এমন এক বাবার কাছে যিনি লড়াই করে চলেছিলেন বিশ্বের অ্যাকাডেমিয়ায় নিজের স্থান করে নিতে। ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইটির পর আমরা তার কাছ থেকে পাই ‘অ্যা ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম’ নামের আরেকটি বই। এই বইটিতে আগের বইয়ের বিষয়গুলোর আরো সম্প্রসারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরেন হকিং। এসব ক্ষেত্রের হালনাগাদ পরিবর্তনের বিষয়গুলোর ওপরও আলোকপাত করেন। স্ট্রিং থিওরি থেকে শুরু করে পদার্থবিজ্ঞানের সব ফোর্সের ইউনিফাইড থিওরির অনুসন্ধান পর্যন্ত বিষয়াবলি এতে আলোচিত হয়। ‘ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার এসেইজ’ নামের বইটি তার প্রথম রচনা সঙ্কলন। এতে তার কিছু রচনার পাশাপাশি আলোকপাত রয়েছে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর। বিষয়গুলো ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে পুরোপুরি বিজ্ঞানের বিষয় পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন একজন বিজ্ঞানী, মানুষ ও বিশ্বনাগরিক হিসেবে। হকিং তার লেখা ২০০ পৃষ্ঠার বই ‘দ্য ইউনিভার্স ইন অ্যা নাটশেল’-এ তিনি তার পপুলার ফিজিক্সের রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম থিওরি, অতীত সুপারস্ট্রিং থিওরি ও ইমাজিনারি টাইমের সীমানাকে ছাপিয়ে নিয়ে গেছেন একটি নতুন হতহ্বিলকর এম-থিওরির জগতে। মানবজাতি সম্পর্কে সবসময় ভাবতেন এই বিজ্ঞানী। তাই ভবিষ্যৎ মানবজাতিকে তার বোধ বিশ্বাসের আলোকে কিছু আগাম বার্তাও দিয়ে গেছেন।
হকিং বিশ্বাস করতেন, এই পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বলে গেছেন, পাঁচভাবে এই পৃথিবী বা মানবজাতির বিনাশ ঘটতে পারে। মানবজাতির ধ্বংসের এসব ধরন উল্লেখ করার পাশাপাশি তার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মানবজাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার কিছু উপায়ও বাতলে গেছেন। প্রথমত, তার মতে- এই পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে একটি অগ্নিগোলকের মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, আগামী ৬০০ বছরের মধ্যে মানবজাতির বিনাশ ঘটবে। ৬০০ বছর পর পৃথিবী ভয়াবহভাবে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ হবে। তখন আমাদের অতিরিক্ত জ্বালানি ভোগের কারণে এই পৃথিবীটা অতিমাত্রায় উষ্ণ হয়ে একটা জ্বলন্ত অগ্নিগোলকে পরিণত হবে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে বেজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় encent WE Summit। সেখানে বক্তব্য রাখেন স্টিফেন হকিং। তার বক্তব্য শোনার জন্য গোটা বিশ্ব থেকে বহু বিজ্ঞানী এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে হকিং বলেন, ‘২৬০০ সালে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা এতটাই অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে যাবে যে, মানুষকে কাঁধের সাথে কাঁধ লাগিয়ে বসবাস করতে হবে। বিদ্যুৎ পৃথিবীটাকে অগ্নিগোলকের মতো উত্তপ্ত করে তুলবে। এ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য মানুষকে ধারণা নিতে হবে আমেরিকান টিভি সিরিজ ‘স্টার ট্রেক’ থেকে। তার কথা হচ্ছে, সাহসের সাথে এগিয়ে যেতে হবে সেখানে, যেখানে এর আগে কেউ যায়নি। তিনি এও বলে গেছেন, মানুষকে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে আলোর গতিতে চলার জন্য। দ্বিতীয়ত, তিনি আরো বলে গেছেন- একসময় রোবট দখল করে ফেলবে এই পৃথিবীটা। Wired.co.uk-এর সাথে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হকিং বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিকে আমাদের আরো সামনে এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু সাথে সাথে এর প্রকৃত বিপদ সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমার ভয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট একটি মানুষের পুরো স্থানটিও দখল করে নেয় কিনা। এটি হবে নতুন ধরনের এক জীবন, যা মানুষের আজকের জীবনকে ছাড়িয়ে যাবে।’ তৃতীয়ত, তিনি বলেছেন মানবজাতিকে বাঁচাতে হলে, ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের আরকটি গ্রহে বসবাস গড়ে তুলতে হবে।
তার মত, মানবজাতির বিলুপ্তি ঠেকাতে হলে আমাদের প্রযুক্তিক সক্ষমতা পুরোদমে বাড়িয়ে তুলতে হবে। আমরা যদি বসবাসের জন্য আরেকটি গ্রহ খুঁজে বের করতে না পারি, তবে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে এই পৃথিবীর আবহাওয়ায় যে পরিবর্তন আসবে, তাই শেষ পর্র্যন্ত আমাদের বিনাশ ঘটাবে। এই বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এ বছরের প্রামাণ্যচিত্র ‘এক্সপেডিশন নিউ আর্থ’-এ। এই প্রামাণ্যচিত্রে হকিং তালিকাভুক্ত করেছেন প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফি গ্যালটার্ডকে, এই আন্তঃগ্রহ ভ্রমণের সম্ভাবনা উদঘাটনের জন্য। Wired-এর সাথে তার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন- তার বিশ্বাস, আমাদের গ্রহটি আজ এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে ফেরার পথ নেই। চতুর্থত, তিনি বলেছেন- মানুষের আগ্রাসন ও পারমাণবিক প্রযুক্তি শেষ পর্যন্ত আমাদের ধ্বংস করতে পারে। তার ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে বিবিসির সাথে দেয়া সাক্ষাৎকারে হকিং বলেন, ‘আমার ভয় বিবর্তন মানুষের জেনোমের ভেতরে তৈরি করেছে তথা ইনবিল্ট লোভ আর আগ্রাসন। দ্বন্দ্ব কমানোর কোনো ইঙ্গিত নেই। সামরিক প্রযুক্তি ও ব্যাপকবিধ্বংসী অস্ত্রের উদ্ভাবন আমাদের জন্য ধ্বংস বয়ে আনতে পারে। মানবজাতির টিকে থাকার সর্বোত্তম উপায় হতে পারে মহাকাশে স্বাধীন কলোনি গড়ে তোলা।’ এই বিশ্বাস থেকেই তিনি বিশ্বের সব দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গেছেন আগ্রাসন যন্ত্র থেকে মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য। পঞ্চমত, তিনি পৃথিবী ধ্বংসের প্রশ্নে প্রসঙ্গ টেনেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকার। তিনি এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের সমালোচনা করতে কোনো সঙ্কোচ করেননি। প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প যখন ঘোষণা দেন প্যারিস আবহাওয়া পরিবর্তন চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না, তখন হকিং ছিলেন ট্রাম্পের সমালোচকদের অন্যতম একজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে, উষ্ণায়নের হুমকি থেকে পৃথিবীর মানুষকে বাঁচানো। এটি পৃথিবীর উষ্ণায়ন রোধের একটি বৈশ্বিক প্রয়াস। তার জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে গত জুলাইয়ে তিনি বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তার এই ঘোষণা পৃথিবী থেকে তথা মানবজাতি থেকে তাকে প্রত্যাহার করে নেয়ার শামিল। যেকোনো বিবেকবান মানুষই বলবেন, ট্রাম্পের কার্যকলাপে হকিংয়ের প্রবল বিরোধিতা শতভাগ যৌক্তিক। কারণ, প্যারিস আবহাওয়া পরিবর্তন চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেয়ার অর্থ হচ্ছে, কার্যত পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দেয়ায় ট্রাম্পের এক চরম ভণ্ডামিপূর্ণ শঠতা।
তা ছাড়া তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণের পর নেয়া সিদ্ধান্তগুলো গোটা বিশ্বকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে অন্তহীন যুদ্ধবিগ্রহের দিকে। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরে তার ঘোষণা এর একটি জায়মান উদাহরণ। ট্রম্পের নীতি হচ্ছে, আমেরিকা ফার্স্ট, আমেরিকার সুপ্র্রিমেসি ধরে রাখতে হবে। গোটা বিশ্ব থাকবে আমেরিকার প্রভাব বলয়ে। আর তার জন্য প্রয়োজন আমেরিকার সামরিক শক্তিবল বাড়ানো। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় যে পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, তা রাশিয়ার এক বছরের সামরিক ব্যয়ের সমান; কিন্তু আমেরিকার গরিব মানুষদের প্রতি নেই ট্রাম্পের নজর। অনেকেই জেনে অবাক হবেন, চার কোটি আমেরিকান অর্থাৎ প্রতি আটজনে একজন আমেরিকান দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত। এদের অর্ধেক চিহ্নিত ‘ডিপ পোভার্টি’ শ্রেণীভুক্ত। প্রটেস্ট্যান্ট মিনিস্টার ও নর্থ ক্যারোলিনার রাজনৈতিক নেতা রেভারেন্ড উইলিয়াম বার্বার এখন নতুন আন্দোলন গড়ে তুলছেন ‘পুওর পিপল’স ক্যাম্পেইন নামে। রেভারেন্ড বার্বার মনে করেন, সে দেশে এমন কোনো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হতে পারে না, যেখানে হতদরিদ্রদের একপাশে ঠেলে দেয়া হয়। তার প্রশ্ন- আমেরিকান নাগরিকদের জন্য সত্যিকারের হুমকি কোনটি? এই হুমকি কি উত্তর কোরিয়া, না দেশটির চরম দারিদ্র্য বা ক্ষুধা? সে প্রশ্ন বিবেকবান যেকোনো মানুষেরও। ২০১৭ সালে সিনেট কমিটিতে ইউএস স্পেশাল অপারেশনস কমান্ড (SOCOM)-এর প্রধান জেনারেল র‌্যামন্ড থমাস বলেন : ‘We operate and fight in every corner of the world’। তিনি জানান, পৃথিবীর সবখানে রয়েছে আমেরিকার স্পেশাল অপারেশন ফোর্স। আর এরা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করে চলেছে। শুনতে অবাক লাগে, ২০১৭ সালে বিশ্বের ১৪৯টি দেশে Navy SEALs I Army Green Berets-সহ ইউএস স্পেশাল অপারেশন ফোর্স মোতায়েন রয়েছে। বিশ্বের ৭৫ শতাংশ দেশে মোতায়েন রয়েছে আমেরিকার সৈন্যরা জর্জ বুশের আমলে যত দেশে আমেরিকার সৈন্য মোতায়েন ছিল, ট্রাম্পের বর্তমান সময়ে সে সংখ্যা তার চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি। এই ট্রাম্পের সমালোচনা খোলাখুলিভাবে করে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং সত্যিই নিজেকে বিশ্বের মানুষের কাছে করে তুলেছেন অনন্য শ্রদ্ধারপাত্র।

No comments

Powered by Blogger.