সরকারি চাকরিতে মেধা-যোগ্যতার চেয়ে কোটার প্রাধান্য

সরকারি চাকরিতে কোটা থাকবে কি থাকবে না- এ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে এ কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন লাগাতার আন্দোলনে রাজপথে সোচ্চার, তখন এ বিতর্ক নতুন করে উঠেছে। এ আন্দোলন শুরুর অনেকটা সাথে সাথেই সরকারের সর্বোচ্চ প্রশাসন থেকে একটি সিদ্ধান্ত আকারে বিবৃতি আসে। এ বিবৃতি ‘আগুনে ঘৃতাহুতি’র মতোই হয়েছে। এ আন্দোলন আরো তীব্র ও লাগাতার রূপ নিয়েছে। প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ নিয়ে চাকরি প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা সোচ্চার। তারা মানববন্ধন, র্যালিসহ শান্তিপূর্ণ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। এগুলো হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পোষ্যদের ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ ও প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ রয়েছে মাত্র ৪৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ৫ নভেম্বর এক নির্বাহী আদেশে সরকারি, আধা সরকারি, প্রতিরক্ষা ও জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানে জেলা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ও ১০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের জন্য কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে এই কোটা পদ্ধতির সংস্কার, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করা হয়। সর্বশেষ পরিমার্জনে কোটা সংরক্ষণ হচ্ছে ৫৬ শতাংশ। সরকারি কর্ম কমিশনসহ (পিএসসি) সরকারের বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন একাধিকবার বর্তমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছেন। কিন্তু কোনো সরকারের আমলেই এসব সুপারিশ শতভাগ কার্যকর হয়নি। আর বর্তমান সরকার আগের মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের সন্তান ও তাদের পোষ্যদেরও কোটার আওতায় আনার পর এ বিতর্ক আরো তীব্র হয়। কোটার কারণে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ডিগ্রিধারী মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। কোটার কারণে দেশের মেধাবীরা আজ বিপন্ন ও হতাশাগ্রস্ত। আর এর ফলেই মেধার পাচার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এমনই প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোজাম্মেল হক সম্প্রতি একটি বিবৃতি দেন। তাতে তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারে আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই।দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবতন ঘটেছে গত ৪৭ বছরে। স্বাধীনতার পর পরই দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বা সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে টেনে তোলার জন্য কোটা সংরক্ষণ জরুরি ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। কিন্তু দেশ এখন নিম্ন আয়ের থেকে মধ্যম আয়ের দেশের উত্তরণ ঘটার পরই কোটা সংরক্ষণের বিধানকে অবাস্তব ও উদ্ভট বলে মনে করেন বিজ্ঞজনেরা। তাদের মধ্যে অন্যতম সরকারের সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান। কোটা সংরক্ষণকে উদ্ভট ও অবাস্তব আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, পৃথিবীর এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোটা মেধাকে ছাপিয়ে যেতে পারে। আমরা পারছি। অর্থাৎ উল্টো যাত্রায় প্রথম। কোনো দেশেই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু রাখার নিয়ম নেই। কোটার কারণে দেশের মেধাবীরা বিপন্ন ও বঞ্চিত হচ্ছে। কোটা বন্ধ হলে অনেক মেধাবীই চাকরি পাবেন বলে তিনি মনে করেন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারও মনে করেন, বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা অবশ্যই সংস্কার হওয়া উচিত। এর ফলে মেধার পাচার রোধ করা যাচ্ছে না। দেশের মেধাবীরা বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
কোটা পদ্ধতি চালু রাখা বৈষম্যমূলক ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৪৭ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী। চাকরি প্রত্যাশীদের দেয়া তথ্য মতে, দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণ আছে ৩৬ শতাংশ। এর মধ্যে ১ দশমিক ১০ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ, ১ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধীর জন্য ১ শতাংশ আর ০ দশমিক ১৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা পোষ্যদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা। ৫০ শতাংশ নারীর জন্য কোটা ১০ শতাংশ আর সব জেলার অংশগ্রহণমূলক নিয়োগের জন্য ১০ শতাংশ কোটা। তবে সংরক্ষিত কোটা ৫৬ শতাংশের মধ্য থেকেই অপশনাল ১ শতাংশ হচ্ছে প্রতিবন্ধী কোটা। ফলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া ১৯৭২ সালে যখন কোটা পদ্ধতি চালু হয়, তখন দেশে জেলার সংখ্যা ছিল ১৭টি, এখন জেলা ৬৪টি। এত দিন নিয়ম ছিল নির্ধারিত কোটায় যদি উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না যায়, তাহলে পদগুলো শূন্য থাকবে। মেধাবীদের থেকে সেগুলো পূরণের কোনো সুযোগ ছিল না। সম্প্রতি এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এখন থেকে নির্ধারিত কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাবীদের তালিকা থেকে পূরণ করা হবে। কোটা সংরক্ষণের কারণে ২৮তম বিসিএসে ৮১৩টি, ২৯তম ৭৯২টি, ৩০তম ৭৮৪টি, ৩১তম ৭৭৩টি আর ৩৫তম বিসিএসে ৩৩৮টি পদ খালিই থেকেছে। তবে ৩৬তম বিসিএসে কোটা পূরণ না হওয়ায় ৩৭তম থেকে তা পূরণ করা হয়েছে। কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতি চালুর মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে তুলনামূলকভাবে একটু বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অগ্রসর গোষ্ঠীতে পরিণত করা; যাতে দেশে কোনো প্রকার বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়। কিন্তু বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নেই। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এই কোটা পদ্ধতির সংস্কারের পক্ষে। তারা জানান, পাঁচ দাবিতে তারা আন্দোলন করছেন। এগুলো হচ্ছে কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেয়া, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা।

No comments

Powered by Blogger.