খেলাপি ঋণ বনাম আইএমএফের পরামর্শ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিনিধি দল ১২ দিনব্যাপী বাংলাদেশ সফর করেন। তারা দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরের হাল অবস্থা দেখার জন্যই এ সফরে আসেন। বাংলাদেশ সফরকালে আইএমএফ প্রতিনিধি দল ব্যাংকিং সেক্টরের সার্বিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ ত্যাগের আগের দিন এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি আরও জোরদার করার পরামর্শ দেন। তারা ব্যাংকিং সেক্টরের বিদ্যমান খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দেন।এমনকি এজন্য প্রয়োজনে বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার সংস্কারও চেয়েছেন। তারা বলেছেন- প্রবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ তহবিল সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে আর্থিক খাতকে আরও কার্যকর করতে হবে। এজন্য ব্যাংকিং সেক্টর, বিশেষ করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোয় নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি আরও বৃদ্ধি করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো ধরনের শৈথিল্য কাম্য নয়। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণ, বিশেষ করে মন্দ ঋণ আদায়ের জন্য বিদ্যমান আইনের সংস্কার করতে হবে। ব্যাংক ঋণ এবং আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার বাজার চাহিদার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এতে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে। প্রতিনিধি দল আরও বলেছেন, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা ভালো থাকায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন দ্বিতীয়বারের মতো ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। প্রবৃদ্ধির এ ধারা বহাল থাকলে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে। এজন্য আর্থিক খাতকে আরও কার্যকর ও সুসংহত করতে হবে।
একইসঙ্গে তারা ট্যাক্স জিডিপি রেশিও আরও বৃদ্ধির জন্য তাগিদ দেন। প্রতিবেশী দেশগুলোয় ট্যাক্স জিডিপি রেশিও আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশকে উন্নয়ন কার্যক্রম বজায় রাখতে হলে ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বাড়াতেই হবে। সফরকালে আইএমএফ প্রতিনিধি দল দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অর্থনীতির অন্যান্য খাত ভালো করলেও ব্যাংকিং সেক্টর সেই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সমানভাবে তাল মেলাতে পারছে না। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য মারাত্মক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। খেলাপি ঋণের ইস্যুটি নিয়ে নানাভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে এই আলোচনা, তাদের কর্ণকুহরে বিষয়টি প্রবেশ করছে না। অথবা প্রবেশ করলেও দুর্বোধ্য কারণে তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।আইএমএফ প্রতিনিধি দল খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন। বিশেষ করে মন্দ ঋণ যাতে আদায় করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে বলেছেন। কিন্তু দেশের বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থা নানা কারণেই দীর্ঘসূত্রতার জন্ম দিচ্ছে। নানাভাবেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা আইনি সহায়তা পেয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংক কোনো মামলায় জয়লাভ করলে পরাজিত পক্ষ উচ্চতর আদালতে আপিল করে সেই রায় ঠেকিয়ে রাখেন দীর্ঘদিনের জন্য। যেহেতু প্রচলিত আইনে তাকে আপিল করার সুযোগ দেয়া হয়েছে, তাই তিনি আপিল করতেই পারেন। তাই ব্যাংক ঋণখেলাপির আপিল করার অধিকার রহিত করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে। যেহেতু ঋণ গ্রহণের সময় বন্ধকী সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করে দিতে হয়, তাই ব্যাংক নতুন করে কোনো ধরনের আইনের আশ্রয় গ্রহণ না করে সরাসরি সেই সম্পদ যাতে বিক্রি করতে পারে- তেমন একটি ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটা করা হলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের ঋণের টাকা আটকে রাখার সাহস পাবে না। এছাড়া ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা বন্ধকীযোগ্য সম্পদ ভ্যালুয়েশনের দায়িত্ব পালন করেন, তাদের কঠোরতম জবাবদিহিতার আওতায় আনা যেতে পারে। কোনো কর্মকর্তা যদি বিশেষ উদ্দেশ্যে ওভার ভ্যালুয়েশন করেন, তাহলে অন্য একটি পরিদর্শক টিম দিয়ে খুব সহজেই তা খুঁজে বের করা সম্ভব। বস্তুত প্রত্যেক কর্মকর্তার সম্পাদিত কাজের জন্য তাকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে সাধারণত একজন উদ্যোক্তার পক্ষে ঋণখেলাপি হওয়া খুব একটা সহজ নয়।
এটা বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে যে, এক শ্রেণীর অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা নানাভাবে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়ার কাজে সহায়তা করেন। যেসব কর্মকর্তা বিভিন্ন পর্যায়ে ঋণ মঞ্জুরের দায়িত্ব পালন করবেন, পরবর্তী সময়ে তারা সেই দায়িত্ব থেকে সরে গেলেও তাদের কোনো না কোনোভাবে ঋণ আদায়ের দায়িত্বে নিযুক্ত রাখতে হবে। কারও উদ্যোগে দেয়া ঋণ যদি খেলাপি হয়ে যায়, তাহলে সেই খেলাপি ঋণের দায়ভার তাকেই বহন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে তার আর্থিক সুবিধাদি আটকে দেয়া যেতে পারে। কারণ প্রত্যেক কর্মকর্তাকে যেমন আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেয়া হয়, তেমনি তার সেই ক্ষমতা প্রয়োগে সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটলে তাকেই সেজন্য দায়ী হতে হবে। এটা করা গেলে ক্ষমতার অপব্যবহার অনেকটাই হ্রাস পাবে। অবলোপনকৃত ৪৫ হাজার কোটি টাকাসহ খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর বিবিধ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার এবং স্প্রেড অত্যন্ত বেশি হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক মূলধন সংকটে পতিত হচ্ছে। কথায় বলে, ‘মিথ্যা হচ্ছে সকল পাপের উৎস।’ ঠিক তেমনি ব্যাংকিং সেক্টরে সব দুরবস্থার মূলে রয়েছে খেলাপি ঋণ। ঋণখেলাপিদের সবাইকে আবার একই পাল্লায় পরিমাপ করার সুযোগ নেই। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে যারা ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হন, তাদের মধ্যে দুটি শ্রেণী আছে। এক শ্রেণীর ঋণ গ্রহীতা আছেন যারা নানা বিরূপ পরিস্থিতির কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। এরা প্রকৃতই ঋণখেলাপি। এদের নানাভাবে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ঋণ পরিশোধে সামর্থ্যবান করে তোলা বিশেষ প্রয়োজন। এদের সুদ মওকুফ, ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ ইত্যাদি সুবিধা দিয়ে ঋণ পরিশোধের উপযোগী করে তোলা যেতে পারে। ব্যাংকিং সেক্টরে যত সুযোগ-সুবিধা প্রচলিত আছে, তার সবই এদের জন্য প্রয়োগ করা যেতে পারে। আর এক শ্রেণীর ঋণখেলাপি আছেন, যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন না। এরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এরা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এদের কারণেই ব্যাংকিং সেক্টরের এই দশা হয়েছে। অনেকেই আছেন, যারা ঋণ ফেরত দিতে হবে না বা দেব না- এই মনোভাব নিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আসেন। ব্যাংক কর্তকর্তাদের এরা নানাভাবে প্রলুব্ধ করে থাকেন ঋণ প্রদানের জন্য। ঋণ আবেদনকারীর আচরণ ভবিষ্যতে কেমন হতে পারে, একজন দক্ষ ও সৎ ব্যাংকারের তা প্রথমেই বুঝতে পারার কথা। আমাদের দেশে একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কিছু দিন তা নিয়ে হইচই করা হয়। কিন্তু ঘটনাটি যাতে সংঘটিত হতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা মোটেও সচেতন নই। খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হওয়ার পর তা নিয়ে হইচই না করে বরং খেলাপি ঋণ যাতে সৃষ্টি না হতে পারে, সে ব্যবস্থা করাটাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে, বাঁধের উজানে কেউ যদি পানি ঘোলা করে, তাহলে ভাটিতে সেই ঘোলা পানিই প্রবাহিত হবে। আমরা যদি ভাটিতে পরিষ্কার পানি পেতে চাই, তাহলে উজানে যিনি বা যারা পানি ঘোলা করছেন, তাদের অপসারণ করতে হবে। এজন্য যত কঠোর ব্যবস্থাই গ্রহণ করা আবশ্যক হোক না কেন, তা করতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে অনেক ধরনের আইন চালু আছে। এসব আইনের মাধ্যমে সাধারণত বিপন্ন প্রায় ঋণগ্রহীতাদের প্রণোদনা দেয়া হয়। যেমন সুদ মওকুফ, দণ্ড সুদ মওকুফ, ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ, ঋণ হিসাব অবলোপন ইত্যাদি। এসব সুবিধা কারা পাচ্ছেন, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। প্রচলিত ব্যবস্থায় একজন নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী কিন্তু ব্যাপকভাবে সুদ মওকুফ সুবিধা পান না। কিন্তু যারা ঋণের কিস্তি বছরের পর বছর আটকে রাখেন, তারা এসব সুবিধা পাচ্ছেন। একজন ঋণগ্রহীতা ১০ বছর নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার পর যদি তেমন কোনো মওকুফ সুবিধা না পান, তাহলে তিনি হতাশ হতে বাধ্য। আর একজন ঋণখেলাপি ১০ বছর ঋণের টাকা আটকে রেখে যদি বিশেষ বিবেচনায় ১০০ শতাংশ দণ্ড সুদ এবং ৫০ শতাংশ সাধারণ সুদ মওকুফ সুবিধা পান, তাহলে পাগলেও বোধহয় নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধে আগ্রহী হবেন না। বরং যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে আসছিলেন, তারাও এক সময় ঋণখেলাপি হতে প্রলুব্ধ হতে পারেন। যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে থাকেন,
তাদের যদি নানা ধরনের মওকুফ সুবিধা এবং আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হয়, তাহলে তারা ভবিষ্যতেও নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবেন, উপরন্তু তাদের দেখাদেখি ঋণ খেলাপিরাও মওকুফ সুবিধা পাওয়ার আশায় নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধে আগ্রহী হবেন। এছাড়া যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে আসছেন, তাদের ৩-৪ বছরের ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ দেখে তুলনামূলক স্বল্প সুদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কোনো সময় ঋণের কিস্তি পরিশোধে বিলম্ব হলে তাদের ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করে দেয়া যেতে পারে। কোনো কোনো ব্যাংক, বিশেষ করে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সুশাসন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এসব ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধেই নানা ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। ব্যাংকিং ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে চাইলে পরিচালনা বোর্ড এবং ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ পর্যায়কে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে সততা নিয়ে সন্দেহ আছে- এমন কোনো ব্যক্তি প্রবেশ করতে না পারে। ব্যাংক একটি ব্যবসায় বটে, কিন্তু এটা আলু-পটলের মতো সাধারণ ব্যবসায় নয়। প্রতিটি ব্যাংকে অভ্যন্তরীণভাবে পরীক্ষিত সৎ এবং নির্মোহ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ব্যাংকগুলোয় শুদ্ধাচার এবং সততা কমিটি আছে। এই কমিটিতে এমন সব কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া যেতে পারে, চাকরিজীবনে যারা সততার কষ্টিপাথরে যাচাইকৃত। মাঝেমধ্যেই ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবি ওঠে। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য কোনো দাবি নয়। কারণ ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা আমরা প্রায় সবাই জানি। সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য কমিশন গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই, বরং এখন দরকার অ্যাকশন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণই হতে পারে ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য সবচেয়ে বড় দাওয়াই।
এম এ খালেক : অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.