ঢাকা-থিম্পুকে ধরে রাখতে দিল্লি মরিয়া by মাসুম খলিলী

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে চীনের সক্রিয়তাবাদী নীতি গ্রহণের পর নিজের একান্ত বলয়ে বাংলাদেশ ও ভুটানকে ধরে রাখতে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে নয়াদিল্লি। দু’টি দেশেই চলতি বছরের শেষ ভাগে অনুষ্ঠিত হবে সাধারণ নির্বাচন। এ উপলক্ষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী মাসে ভুটান, বাংলাদেশ ও নেপাল ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন। আগামী সাধারণ নির্বাচনে থিম্পু ও ঢাকা, উভয় সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভুটান ও বাংলাদেশ ভ্রমণের উদ্যোগ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। হিমালয়ান রাজ্য ভুটান সফরকালে ভারতের আর্থিক সহায়তায় একটি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু করার কথা বলবেন মোদি। আর ঢাকা সফরের সময় তিনি তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে একটি নতুন চুক্তি করতে পারেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্য সফরের মুখ্য কারণ হলো- এই দুটি দেশে চীনের প্রভাব ঠেকানো। দোকলামসহ সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শিগগিরই ভুটানের সাথে সীমান্ত আলোচনায় বসছে চীন। চলতি মাসের শেষ দিকে অথবা এপ্রিলে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে। ২৫তম রাউন্ডের এ সীমান্ত আলোচনায় চীনের পক্ষ থেকে ভাইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোং জোয়াংইউ এবং ভুটানের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিউনপো ডামকো দোর্জি নেতৃত্ব দেবেন। ২০১৬ সালে ২৪তম বৈঠকেও তারাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে একের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অন্যজন অবহিত রয়েছেন। দোকলাম সঙ্কটের কারণে ২০১৭ সালে ২৫তম সীমান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এবারের আলোচনার পশ্চিম সেক্টরের দোকলাম ছাড়াও ছরিতাং, ড্রামানা সিনছুলান নিয়ে কথাবার্তা হবে। ভারত-ভুটান-তিব্বতের ‘ত্রিমোহনা’র অদূরে অবস্থিত দোকলামের আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই ভুটানের কাছে। চীনের জন্য এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ বলে তারা এর বিপরীতে তিনগুণ এলাকার দাবিও ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছে। এ ব্যাপারে ভুটানের কোনো আপত্তি না থাকলেও দিল্লির বাধার কারণে চুক্তি চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। দিল্লি মনে করে, এখানে চীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পেলে বেইজিং সহজেই চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর ছিন্ন করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে ভারতের মূল ভূখণ্ডকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে। থিম্পু চায় না দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর টানাটানির মধ্যে পড়ে ভুটানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হোক। দিল্লির মনে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, সীমান্ত বিরোধ নিরসনের পথ ধরে চীনের সাথে ভুটানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতে পারে।এ কারণে চীনের সাথে সীমান্ত আলোচনার আগেই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধান একযোগে থিম্পু সফর করেছেন। এর পরই যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। দিল্লির এ উদ্যোগ দোকলাম নিয়ে সমঝোতা কতটুকু বাধাগ্রস্ত করতে পারবে, তাতে সন্দেহ রয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা ওই এলাকা ছাড়ার পর সেখানে চীন দুই দিনের মধ্যেই একটি ছোটখাট সেনানিবাস তৈরি করে ফেলেছে। এখন দিল্লির প্রধান উদ্বেগ হলো, বেইজিংয়ের সাথে থিম্পুর আনুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় কি না। দিল্লির এমন আশঙ্কা রয়েছে যে, চলতি সালের শেষার্ধে ভুটানে যে সংসদ নির্বাচন হবার কথা রয়েছে তাতে আবার চীনপন্থী দল জিতে ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে এ ধরনের একটি সরকারের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে ভারত ভুটানের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে জনগণের জীবন বিষিয়ে তুলেছিল। আর এবার ভারতপন্থী দলের সুবিধার জন্য নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন মোদি।
দিল্লির নীতিনির্ধারকদের ভুটানের ব্যাপারে বড় ভয়ের কারণ হলোÑ দেশটির সংসদের দুই কক্ষই মিলিতভাবে ভারতের বিশেষ আগ্রহে নেয়া প্রকল্প বিবিআইএন অনমোদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ ধরনের সাহস ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের সরকার আজও দেখাতে পারেনি। ভুটান ভারতের আশ্রিত ধরনের দেশ হওয়া সত্ত্বেও এক ধরনের সংবেদনশীলতার কারণে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর সর্বপ্রথম বিদেশ সফরের জন্য এই ক্ষুদ্র প্রতিবেশীকে বেছে নিয়েছিলেন। পরে দোকলাম সঙ্কট সৃষ্টির পর এর গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন অনেকে। এ কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো সময়ের জন্য ভুটানকে ভারতের রাডার থেকে আড়াল হতে দেয়া হয়নি। ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত অল্প সময়ের মধ্যে তিনবার দেশটি সফর করেছেন। বস্তুত দোকলাম ঘটনার পরই ভুটান নিয়ে যেকোনো সময় চীনের একটি বড়ধাক্কা দেয়ার সঙ্কেত আসে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ভারতের আপত্তির কারণে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের সাথে ভুটানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। এ কারণে সম্পর্ক নেই চীনেরও। ভুটানের জনগণ এটাকে কোনোভাবে সমর্থন করে না। ফলে চীনের জন্য ভুটানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টির সুযোগ এখন সামনে এসেছে। ভুটানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুটানের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল আসার পরেই ভারত ও চীন উভয়ের সাথে দেশটি তার সম্পর্কের বিষয়টি পুনর্বিন্যস্ত করতে পারে। এ বিন্যাসে বেইজিং যাতে কোনো ছাড় না পায়, সেটিই নিশ্চিত করতে চায় দিল্লি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভুটানের পর বাংলাদেশই এখনো ভারতের একান্ত প্রভাব বলয়ে রয়েছে বলে মনে করা যায়। কিন্তু চীনের সাথে আগে থেকে চলে আসা ঢাকার বিশেষ সম্পর্কের কারণে দিল্লির সামনে প্রায়ই এ নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে। চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ দুটি সাবমেরিন কেনার পর ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো এ নিয়ে শোরগোল বাধিয়ে দেয়। বাংলাদেশকে ব্যাপকভিত্তিক একটি নিরাপত্তা চুক্তি করার জন্য চাপ দেয়া হয় দিল্লি থেকে। ট্রানজিটের অবকাঠামোগুলো নির্মাণ দ্রুত সম্পন্ন করে তা কার্যকর করার জন্যও বলা হলো। বাংলাদেশ নিরাপত্তা চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করলেও ভারতের পক্ষ থেকে এর বিনিময়ে তিস্তার পানি বণ্টনের কোনো চুক্তি করা হয়নি। তখন নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে জানান, তিস্তা চুক্তি নির্বাচনের আগে আগে হলে জনমতের ওপর এর প্রভাব থাকবে। এখন আভাস পাওয়া যাচ্ছে, পরবর্তী মেয়াদে ভারতীয় এজেন্ডা পূরণের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ও চুক্তির পর তিস্তার পানি বণ্টন এবং ক্ষমতায় যেতে চূড়ান্ত সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। দিল্লির সংবেদনশীলতার মূল কেন্দ্রে রয়েছে চীন। চীনের কাছে প্রভাব বিস্তারের গেমে ভারত হেরে গেছে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও নেপালে। তারা গভীর সমুদ্রবন্দরসহ রোড অ্যান্ড বেল্টের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব মানতে চায় না। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশ সফরকালে ২৪ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার বড় অংশই ছিল এর সাথে যুক্ত। এখন বাংলাদেশ বিআরআই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের পক্ষ থেকে চাপের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা হয়। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সমরসজ্জার কারণেও এক ধরনের চাপে রয়েছে ঢাকা। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে চলতি বছরের এ দেশ প্রথমার্ধেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ফের সফর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। মোদির সফরের তারিখ যদিও নিশ্চিত করা হয়নি, তবে তা চূড়ান্ত করা হচ্ছে বলে ইকোনমিক টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে। মোদির এ সফর নিছক একটি সফর হবে না। তিনি নতুন মেয়াদে কী ধরনের সম্পৃক্ততার বন্ধনে বাংলাদেশের সাথে আবদ্ধ হতে চান, সেটি চূড়ান্ত করতে চাচ্ছেন আগেভাগেই। আন্তর্জাতিক একটি শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি মোদির প্রস্তাবিত এ ঢাকা সফর হবে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বর্তমানে পাঁচ দিনের সফরে ভারত রয়েছেন। এর পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বার্তা নিয়ে দিল্লি যেতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভি যখন তখন আসা যাওয়া করেন ভারতে। শেখ হাসিনা মনে করেন, দেশের উন্নয়নের জন্য চীনের সহায়তা প্রয়োজন হলেও ক্ষমতায় যেতে বা টিকে থাকলে ভারতের সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। এবারের সময়টা এমন জটিল যে, আবার ক্ষমতায় যেতে হলে দিল্লির শর্ত মেনে নিতে হবে। এরপর প্রয়োজনে বেইজিংয়ের সাথে সমঝোতায় উপনীত হওয়া সম্ভব হবে বলে তার বিশ্বাস। এ কারণে হয়তোবা বেইজিংয়ের কাছে চরমভাবে অগ্রহণযোগ্য হলেও দিল্লির শর্ত পূরণ করার ব্যাপারে প্রাথমিক বার্তা প্রতিবেশী ভারতকে দেয়া হয়েছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর মোদির সফরে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত রূপ দেয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিক সফরে ঢাকায় থাকাকালে তিনটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। এবার তিনি আরো একবার স্বাগত জানানোর সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন, চীনের বিভিন্ন কোম্পানি এখানে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) ইনিশিয়েটিভের জন্য ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার যে প্রস্তাব দেওয়া হয় তার আওতায় কোনো কাজ শুরু হয়নি। ভারতের উদ্বেগগুলোর প্রতি সংবেদনশীল থাকায় শেখ হাসিনা সরকার চীনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক। আর চীনের সাথে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য বড় কোনো সমঝোতায় না যাওয়ার বিষয়েও দিল্লিকে আশ্বস্ত করা হয়েছে বলে জানা যায়। ভারতের একান্ত বলয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভুটান ছাড়া আর কোনোটাই নেই। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছে নেপালে। নেপালেও যাবেন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনের পর দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা খানিকটা বৃদ্ধির পর দিল্লি শিগগিরই নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলিকে তার প্রথম বিদেশ সফরের ব্যাপারে স্বাগত জানান। বিম্স্টেক সামিটের চতুর্থ রাউন্ডের জন্য মোদি নিজেই কাঠমান্ডু যেতে পারেন। মোদিকে আগামী বছর নির্বাচনে ভোটারদের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি যদি এমন এক অবস্থায় জনগণের মুখোমুখি হন যখন প্রতিবেশী কোনো দেশই আর তার প্রভাব বলয়ে নেই, তখন তিনি ‘ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতি’র জন্য সমালোচিত হতে পারেন। আর এ কারণে কোনোভাবেই তিনি অন্তত বাংলাদেশ ও ভুটানে প্রভাব হারাতে চাইছেন না।
mrkmmb@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.