বেঁচে থাকাটাই যেখানে সাফল্য

সিরিয়ার পূর্ব গৌতার পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সেখানে বেঁচে থাকাটাই যেন সাফল্য। সফল চিকিৎসা যেন এক বাইনারি হিসাব-হয় জীবন, নাহয় মৃত্যু। কথাগুলো পূর্ব গৌতার চার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর। টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তাঁরা এসব কথা বলেছেন। তাঁরা চারজনই নিজেদের আসল পরিচয় ও অবস্থান প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁদের আশঙ্কা, পরিচয় আর অবস্থান প্রকাশ হয়ে গেলে তাঁরাও বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবেন। ৫০ বছর বয়সী হামিদ ওই চারজনের একজন, পেশায় চিকিৎসক। পূর্ব গৌতার ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি ভবনের একটি কক্ষে পরিবার নিয়ে কোনো রকমে বাস করছেন তিনি। একসময় ভবনটি ছিল তাঁদের বাড়ি। পূর্ব গৌতায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর অভিযান শুরুর কয়েক দিনের মাথায় ভবনটি ধ্বংস হয়। কাছের একটি হাসপাতালে তিনি কাজ করেন। প্রতিবার কর্মস্থলে যাওয়ার সময় স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে চুমু খেয়ে বিদায় নেন। ‘এটাই হয়তো পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখা’-এমন চিন্তা বারবার মনের মধ্যে খোঁচা দিলেও তিনি তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। যেদিন ভারী বোমা বর্ষণ করা হয়, সেদিন হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের চাপও থাকে বেশি। কোনো বিরতি ছাড়াই ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় কাজ করে যেতে হয়। চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি রোগী আর নিজের পরিবারের জন্য প্রার্থনাও করেন হামিদ। তাঁর নিজের তিন সন্তানও আহত হয়ে তাঁর হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছে। হামিদ বলেন, ‘এই এলাকায় নিহত বেশির ভাগ শিশুরই মৃত্যু হয়েছে মাথায় অথবা পেট কিংবা তলপেটে বোমার আঘাতে। কোনো কোনো শিশুর হৃদ্যন্ত্রেও গুরুতর আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। লন্ডনে হলে তারা হয়তো বেঁচে যেত। গৌতায় আমরা কিছুই করতে পারি না। আমরা রক্তক্ষরণ বন্ধের চেষ্টা করি এবং তারপর নিয়তির কাছে ছেড়ে দিই।’ এই চিকিৎসক আরও বলেন, গত সপ্তাহে তাঁর হাসপাতালে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু আসে। তার শরীরে একাধিক আঘাত ছিল। ক্ষতস্থানগুলো সেলাই করার পর শিশুটির এক হাত ও এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটাই তার (ওই শিশুর) ভবিষ্যৎ। সে বেঁচে আছে, এটাই সাফল্য।’
একই দিন ১৮ মাস বয়সী এক মেয়েশিশু আসে ব্যারেল বোমার আঘাতে ঊরুতে মারাত্মক ক্ষত নিয়ে। তার ধমনি পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে গেছে। হামিদ প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। রক্তক্ষরণ থামানো গেলেও ধমনি জোড়া লাগানো সম্ভব হয়নি। শিশুটি ভবিষ্যতে কোনো দিন হাঁটতে পারবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। এই চিকিৎসক বলেন, ‘সে বেঁচে আছে। এটাই সাফল্য। একই সপ্তাহে আরও পাঁচ আহত শিশু এসেছিল। তারা সবাই মারা গেছে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমি দুঃখিত, এসব ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসাসামগ্রী শেষ হয়ে আসছে। বড়জোর আর কয়েক সপ্তাহ চিকিৎসা সম্ভব হবে। আগে যে সুতো দিয়ে সেলাই দেওয়া হয়েছে, সেটাই আবার ব্যবহার করছি আমরা। যে দস্তানা আগে ব্যবহার হয়েছে, সেগুলোই আবার ব্যবহার করছি। আগে ব্যবহৃত ব্যান্ডেজগুলো নতুন রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি।’ তিনি বলেন, ‘এখানে যে মানুষগুলো মারা পড়ছে, তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।’ চিকিৎসাশাস্ত্রের শিক্ষার্থী ২৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ এখন পুরোদমে স্বাস্থ্যকর্মী। পরিস্থিতি তাঁকে পড়ালেখা শেষ করতে দেয়নি। একটি ভবনের তিনটি কক্ষে পরিবারের সদস্যসহ ৩০ জন ঠাসাঠাসি করে বাস করছেন। সেখানে নেই বিদ্যুৎ বা পানির সুবিধা। তিনি বলেন, ‘তিন মাস বয়সী এক কন্যাশিশু আর দুই বছর বয়সী এক ছেলেশিশুকে আহত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কন্যাশিশুটি বেঁচে গেছে। কিন্তু ছেলেটি মারা গেছে। তার শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল, তার শরীর থেকে ক্লোরিনের গন্ধ ভেসে আসছিল।’

No comments

Powered by Blogger.