দু’বছরে পদ্মার গর্ভে সহস্রাধিক ঘরবাড়ি: পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি by মো. তারেক রহমান

চাঁপাই নবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গায় পদ্মার ভাঙনে হুমকির মুখে তিনটি বিজিবি ক্যাম্পসহ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় গত ২ বছেরও সম্ভব হয়নি ডিপিপি প্রণয়নের কাজ। শুষ্ক মৌসুমেও ভাঙন অব্যাহত থাকায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের ঘরবাড়ি। দীর্ঘ দু’বছরে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসহযোগিতাকেই দায়ী করছেন ভুক্তভোগীরা। পদ্মার ভাঙনে বিলীনের প্রতীক্ষায় বিজিবির চরবাগডাঙ্গা বিওপি। ছয় মাস আগেও চরবাগডাঙ্গা বিজিবি ক্যাম্প থেকে পদ্মা নদীর দূরত্ব ছিল ৮০০ গজ দূরে। ভাঙন অব্যহত থাকায় বর্তমানে নদীর অবস্থান এসে ঠেকেছে মাত্র ২৫০ গজে। ইতোমধ্যে নদীতে তলিয়ে গেছে ৩টি আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার। ডিপিপি থেকে একনেক সভা তারপর বাজেটে অর্থ প্রাপ্তির প্রতীক্ষা। স্থানীয়দের অভিযোগ জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে রাক্ষুসে পদ্মা গিলে খাবে চরবাগডাঙ্গা। শুধু তাই নয় হুমকির মুখে পড়বে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি ইউনিয়নসহ চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা শহর। এছাড়া ভাঙনের ফলে স্থলসীমা ভেঙে বাড়বে জলসীমা, ফলে ভূখণ্ড হারাবে বাংলাদেশ।
চাঁপাই নবাবগঞ্জস্থ ৯ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আবুল এহসান জানান, গত এক বছর ধরে এখানে যেভাবে ভাঙন চলমান রয়েছে তাতে আমাদের চরবাগডাঙ্গা বিওপিটি অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড দ্রুত বড় ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সামনের বর্ষা মৌসুমে এটি তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি আমরা আমাদের সদর দপ্তরকে অবগত করেছি। এবং জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিজিবি সদর দপ্তর ২০১৭ সালের ১২ই মে মহাপরিচালক পাউবোর কাছে পত্র প্রেরণ করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের পার্শ্ববর্তী কাইড়াপাড়া গত ৩ মাসের মধ্যে তলিয়ে গেছে নদীতে। বিজিবির চরবাগডাঙ্গা বিওপিটি থেকে মাত্র ২৫০ গজ দূর দিয়ে বইছে প্রমত্তা পদ্মা। বিওপির বিজিবি সদস্যরা জানান ইতোমধ্যে তিনটি আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার নদীগর্ভে নেমে গেছে। এসময় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা কাউয়ুম আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, ভাঙতে ভাঙতে নদী এখন ক্যাম্পের কাছে চলে এসেছে। তিন মাস আগেও এখানে আমাদের বাড়ি ছিল, এখন পদ্মা নদীর মাঝখানে। ওই যে চরটি দেখতে পাচ্ছেন সেখানেই আমাদের বাড়ি ছিল।
চাঁপাই নবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চরবাগডাঙ্গা বিওপির কাছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। উজানে ফারাক্কার প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানি না থাকায় বেশ কিছু চর জেগে উঠেছে। ফলে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে চরবাগডাঙ্গার দিকে ধেয়ে আসছে। মূলত এই কারণে চরবাগডাঙ্গা এলাকায় শুষ্ক মৌসুমেও ব্যাপক ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
আলমগীর হোসেন নামে স্থানীয় অধিবাসী জানান, গত দু’বছরে প্রায় ছয়টি গ্রাম নদীতে তলিয়ে গেছে। এখন গোয়ালডুবি এলাকা থেকে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে পদ্মার ভাঙ্গন। ইতোমধ্যে কয়েকটি গ্রামের প্রায় সহস্রাধিক বাড়িঘর, বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি ও আম বাগান পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন অব্যাহত থাকায় নদী তীরবর্তী লোকজন আতঙ্কে তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। হুমকির মধ্যে আছে বিজিবির চরবাগডাঙ্গা বিওপি, ফরিদপুর বিওপি, বাখের আলী কোম্পানি ক্যাম্প, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, ভূমি অফিস, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, দাখিল মাদরাসা ও স্থানীয় একাট হাট।
এ বিষয়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ জানান, চরাঞ্চলের মানুষের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে দুঃখে আমাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এসব কাজ করতে কি পরিমাণ ঝামেলা আর হয়রানির শিকার হতে হয় তারা বিষয়টি জানেন না। সরাসরি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, পাউবোর কিছু অসহযোগিতাকারী কর্মকর্তা সরকারের তথা আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য যে কাজগুলো সহজেই করা সম্ভব সেগুলো না করে ইচ্ছাকৃতভাবে অসহযোগিতা করছে। তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে আমরা চরাঞ্চলে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছি। প্রায় আড়াই কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ বাকি রয়েছে। এই কাজটুকু না করলে পুরো কাজই ভেস্তে যাবে। চরবাগডাঙ্গা এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধ না করা গেলে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা শহরও হুমকির মধ্যে পড়বে বলে জানান তিনি। চাঁপাই নবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম গত ২ বছর থেকে নদী ভাঙনের কথা স্বীকার করে জানান, নদীর ২-১ মিটার মাটি বাকিটা বালি। ফলে বাতাসেই সেগুলো ঝরে পড়ে। সাইনবোর্ড বাজার থেকে ইন্দোবাংলা বর্ডার পর্যন্ত দুই দশমিক ছয় কিলোমিটার নদী প্রতিরক্ষার ডিপিপি তৈরি করেছি। দু-একদিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবো। বিগত দুই বছরে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আসলে সিস্টেমটাই এরকম। বছর খানেক থেকে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, কয়েকবার ডিপিপি তৈরি করে পাঠিয়েছি কিন্তু বারবার ফেতর আসায় আবারো নতুন করে ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে। ডিপিপি থেকে মন্ত্রণালয় তারপর একনেক সভায় যাবে। এরপর অর্থ বরাদ্দের বিষয় আছে। তাছাড়া সামনে বর্ষা মৌসুম সুতরাং কাজটি শুরু হতে সময় লাগবে বলেও তিনি স্বীকার করেন।

No comments

Powered by Blogger.