জোটের বৈঠকে নেতাদের ঐকমত্য আগে খালেদার মুক্তি, পরে নির্বাচন by কাফি কামাল

চার এজেন্ডা নিয়ে ২০ দলীয় জোটের নেতারা বৈঠক করেছেন শনিবার। এজেন্ডাগুলো ছিল- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন বিলম্ব, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের নাম স্বৈরাচারী দেশের তালিকায় যুক্ত হওয়া, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা ও আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কিন্তু নির্ধারিত এজেন্ডা ছাপিয়ে বৈঠকের আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শরিক দলগুলোর আসন বণ্টন ইস্যু। এ ইস্যুতে বৈঠকেই বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছেন শরিক দলের নেতারা। তবে আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও পরে নির্বাচন- এমন সিদ্ধান্তে একমত পোষণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বৈঠক। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে জোটগত কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত ও জোটের সমন্বয়ক পদে পরিবর্তনের সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হয়েছে বৈঠকে। গতকাল জোটের একাধিক সিনিয়র নেতা এসব তথ্য জানিয়েছেন। বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপি জোটের শরিকদলগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকজন নেতা রয়েছেন যারা আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কাজ করছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। জোটের দলগুলোর কাছে বিএনপি মহাসচিব এসব বিষয়ে জানতে চান। জবাবে জোট নেতারা বলেন, দলীয় সিদ্ধান্তে তাদের নেতারা মাঠে রয়েছেন। জোট কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এ আলোচনার মধ্যেই নেতারা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। সূত্র জানায়, বৈঠকে বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ জোটের শরিক দলের নেতাদের উদ্দেশে আসন বণ্টন নিয়ে কয়েকটি দলের গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্য-বিবৃতির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘আসলেই এ ধরনের কোনো তৎপরতা আছে কী না?’ তিনি জানতে চান, কেন তারা এখন আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা দিচ্ছেন। জবাবে সংশ্লিষ্ট নেতারা বিষয়টিকে সরকারের জোটভাঙার কৌশল বলেন। তবে নির্বাচনী আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ কৌশলে জানান, নিজেরসহ পুরনোদের আসন নিশ্চিত রয়েছে এবং এলাকায় তারা কি বলবেন- এমন প্রশ্ন করলে তা নাকচ করে দেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, কারও কোনো আসন কনফার্ম নয়, এ নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে না; এটা চূড়ান্ত করবেন খালেদা জিয়া। রেদোয়ান আহমেদের বক্তব্যটিকে স্বার্থপর আচরণ বলেও মন্তব্য করেছেন জোটের অনেক নেতা। বৈঠক শেষে গুলশান কার্যালয়ে জোট নেতাদের মধ্যে আসন বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়। জোটের কয়েকজন নেতার আক্রমণাত্মক প্রশ্নের জবাবে এক নেতা বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনের যোগ্যতা ও সামর্থ্য আছে তাই আমরা বিএনপির নেতৃত্বের কাছে সম্ভাব্য নির্বাচনী প্রার্থী তালিকা দিয়েছি। এতে দোষের কী হলো? প্রয়োজনে আপনারাও দেন। আমাদেরটা বলতে আপনারা বাধা দেন কেন?’ অন্য আরেকজন কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আমরা কী আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম যে, আমাদের কিছু নিজস্ব বলার নেই, করার নেই? বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ আছি, মামলা খাচ্ছি, গ্রেপ্তার হচ্ছি, অর্র্থ ব্যয় করছি। তাহলে বিএনপিই কেন আমাদের সুনির্দিষ্ট করে কোনো পদক্ষেপের কথা বলছে না। কই, সেটা নিয়ে তো কেউ কথা তোলেনি? অন্তত বিএনপির পক্ষ থেকে এটা তো বলতে পারতো যে, সম্ভাব্য জোট নেতারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ান।’ সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নেতাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে জোটের শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়ার কারামুক্তির আগে নির্বাচনী আসন বণ্টনের বিষয়ে আলোচনা ও বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। খালেদা জিয়ার কারামুক্তির পরই নির্বাচনী আসন বণ্টন নিয়ে শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে। জোটের শরিক দলের এক নেতা জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তির আগে আসন বণ্টনের ব্যাপারে কোনো আলোচনা করা যাবে না। তবে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, যারা নির্বাচন নিয়ে কাজ করতে চান, তারা শুধু নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে প্রস্তুতি নেবেন। যদি সত্যিকার অর্থে নির্বাচন হয়, তাহলে আসন বণ্টন সমন্বয় করা হবে। বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি, এরপর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সাপেক্ষে আসন বণ্টনের বিষয়ে আলোচনা হবে। এ বিষয়ে জোটের সবাই একমত হয়েছেন।’ বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া বলেন, ‘আমাদের প্রথম এজেন্ডা জোটনেত্রীর মুক্তি, এরপরই নির্বাচনের পরিবেশ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হলে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা।’ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, ‘আসনের কথা একেবারে বাদ। এখন একনম্বর এজেন্ডা নেত্রীর মুক্তি, তার আগে আসনের ব্যাপারে কোনো আলোচনা এই সময়ে করা যাবে না।’ জামায়াতের প্রতিনিধি মাওলানা আবদুল হালিম সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন করতে জোটগতভাবেই কর্মসূচি পালন করা হোক। তবে জোটের নেতাদের প্রশ্ন বিএনপির নেতৃত্বে জোট হয়েছে। জোটের যেকোনো শরিক দলের ব্যাপার তারাই আলোচনায় আনবেন। একটি শরিক দলের নেতা হয়ে ব্যারিস্টার পার্থ অন্য শরিক দলের ব্যাপার কিভাবে আলোচনায় আনেন। বৈঠকে তার প্রশ্ন নিয়ে জোট নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে বলেও জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন। জোটের নেতারা জানান, নির্বাচনের আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনার সময় এখনই। কারণ শরিক দলের নেতাদের মধ্যে পুরনো প্রার্থী যেমন আছেন, তেমনি নতুন প্রার্থীও আছেন। তাদের প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। তাই আসনের বিষয়টি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে আলোচনা হলে আরো ভালো হতো। কারণ খালেদা জিয়ার মুক্তি, তার নেতৃত্ব বা সিদ্ধান্ত নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত বা অনাস্থা নেই। কিন্তু তিনি যদি এমন সময় মুক্তি পান যখন এসব আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় না থাকে, তখন কি হবে? সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়টি শরিকরা আলোচনায় তোলেন। এ সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, কয়েক দিনের মধ্যে তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করবেন। সেখানে এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে শরিকদের ইতিবাচক মনোভাব দেখান। বৈঠকে খালেদা জিয়ার জামিন বিলম্বের ব্যাপারে সরকারের নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন নেতারা। পরে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচির বিষয়ে ২০ দলীয় জোট থেকেও কর্মসূচি দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়। শিগগিরই জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে কর্মসূচি ঠিক করা হবে নতুন সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খানের সমন্বয়ে। জোট নেতারা সাংবাদিকদের জানান, জোটের বৈঠকে জেলা সফর, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে প্রচারপত্র বিলির সিদ্ধান্ত হয়। কবে নাগাদ এসব কর্মসূচি পালন করা হবে, তা শিগগিরই ঠিক করা হবে। এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ২০ দলীয় জোটের ঐক্য অটুট রাখা এবং শরিক দলগুলোকে কর্মসূচিতে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘আগে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার জামিন, পরে অন্য আলোচনা। তবে আমরা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে মত দিয়েছি।’ বৈঠকে জার্মান একটি সংস্থার গবেষণায় বাংলাদেশের নাম স্বৈরাচারী দেশের তালিকায় যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করেন নেতারা। এছাড়া সদ্য অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানানো হয়। ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা হিসেবে প্রথম থেকেই দায়িত্ব পালন করছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তিনি কারাগারে যাওয়ার পর জোটের বৈঠকে শীর্ষ নেতার দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা হলেও সবাই এ পদে খালেদা জিয়ার ওপরই আস্থা প্রকাশ করেন। তবে এক্ষেত্রে সবাই যৌথ নেতৃত্বে জোট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। যার ফলে জোটের প্রথম বৈঠকে বিএনপি মহাসচিবের পাশাপাশি দলটির দুই সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অংশ নেন। অন্যদিকে জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবারের বৈঠকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের ওপর। মির্জা আলমগীর ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে নজরুল ইসলাম খানের নাম প্রস্তাব করেন। সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবির আন্দোলনে ২০ দলীয় জোটকে সক্রিয় করতেই জোটের সমন্বয়কারী পরিবর্তন করা হয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে বিএনপির শরিক নেতাদের কারো কারো মধ্যে চাপা অভিমানও ছিল। বড় দলের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কারণে শরিক দলগুলোর নেতাদের প্রত্যাশিত সময় দিতে পারতেন না তিনি। বিএনপি মহাসচিব ও জোটের সমন্বয়ক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে বৈঠকে বিএনপি স্থায়ী কমিটির ৩ সদস্যসহ জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতার উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, খালেদা জিয়া ছাড়া ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা দ্বিতীয়বারের মতো বৈঠক করেছেন শনিবার।

No comments

Powered by Blogger.