সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যের ওপর ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছিলেন ব্লেয়ার

সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইরাক যুদ্ধ করেছিলেন বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে এমন তথ্য তিনি বৃটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপন করেছিলেন পার্লামেন্টের স্বীকৃতি আদায়ে। তিনি বলেছিলেন, সাদ্দাম হোসেনের হাতে যে রাসায়নিক অস্ত্র আছে তা মাত্র ৪৫ মিনিটেই বৃটেনের মূল ভূখন্ডে আঘাত করতে সক্ষম। কিন্তু টনি ব্লেয়ার এক্ষেত্রে যে তথ্যপ্রমাণ দিয়েছিলেন তা ছিল ভুয়া। ‘৪৫ মিনিটস ফ্রড ডুম’ নামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ হাজির করেছিলেন তিনি পার্লামেন্টে। ৫০ পৃষ্ঠার ওই গোপন তথ্যের সূত্র ছিল ইরাকের একজন ট্যাক্সি চালক। তার দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছিল ওই তথ্যপ্রমাণ। শুধু তা-ই নয়। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়া একজন ছাত্রের ডক্টরাল থিসিস পেপার থেকেও তথ্য নিয়ে ওই ডকুমেন্ট সাজানো হয়েছিল। এ জন্য ২০০৩ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি ডাউনিং স্ট্রিট স্বীকার করে তাদের ভুল। তারা ক্ষমা চায়। বলা হয়, ওই ডকুমেন্টের বেশির ভাগই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের লেখা থেকে নেয়া হয়েছে। পরে দেখা যায় এ কাজটি করেছিলেন টনি ব্লেয়ারের যোগাযোগ বিষয়ক প্রধান অ্যালেস্টার ক্যাম্পবেলের ডাউনিং স্ট্রিট অফিসের কিছু মধ্যম সারির কর্মকর্তা। অথচ ওই তথ্যকেই অকাট্য প্রমাণ হিসেবে হাউজ অব কমন্সে উত্থাপন করেন টনি ব্লেয়ার। তিনি পার্লামেন্টকে আস্থায় আনেন যে, ইরাক আগ্রাসন করতেই হবে। এ সময় টাইমস অব লন্ডন সংবাদ শিরোনাম করে ‘মিসাইলস ফ্লাই ইন ৪৫ মিনিটস’। দ্য সানের শিরোনাম ‘বৃটেন ৪৫ মিনিটস ফ্রম ডুম’। এসব শিরোনামে চমকে ওঠে বৃটেন। মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে বৃটেন! এই যে ডকুমেন্ট এই ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করেই টনি ব্লেয়ার ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকে আগ্রাসন চালান। পরে যখন বিষয়টি প্রকাশ পায়, তখন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন ব্লেয়ার। তার বিরুদ্ধে ঘৃণা উপচে পড়তে থাকে। প্রথমে ওই কূটনৈতিক ডকুমেন্টের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন বৃটিশ জীবাণু অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ড. ডেভিড কেলি। এক পর্যায়ে ডা. ডেভিড কেলি আত্মহত্যা করেন বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই আত্মহত্যার যথার্থতা প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন বিবিসির শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা। ফলে যা হয় তাহলো, বিবিসির ওইসব কর্মকর্তারা অনেকে পদত্যাগ করেন। টনি ব্লেয়ার যে ডকুমেন্ট হাজির করেছিলেন তা নিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান লিখেছিল এরকমÑ উচ্চ মাত্রার গোয়েন্দা বিশ্লেষণের পরিবর্তে ওই কূটনৈতিক ডকুমেন্ট বা ডোজিয়ের ছিল মিডিয়ায় প্রচলিত শব্দ কাট-এন্ড-পেস্ট। ফলে ঘটনাটি সারা বিশ্বের মিডিয়া লুফে নেয়। তখন ২০০৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক আগ্রাসনের সমর্থনে বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল। তার বক্তব্যের মূলে উঠে আসে ইরাক আগ্রাসন ও ওই ডকুমেন্টের কথা। এই ডকুমেন্টের বিশ্লেষণ ও এর উৎস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এতে প্রকাশ পেয়েছে কিভাবে গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে পাওয়া সতর্কতাকে অবজ্ঞা করেছে বৃটিশ গোয়েন্দারা। তা ছাড়া যেসব তথ্য তারা পেয়েছিলেন তা বেং তার উৎস চেক করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তারা। তবে সবচেয়ে লজ্জার কথা হলো, এইসব ডকুমেন্ট বা ডোজিয়েরকে যথার্থতা দিতে প্রধানমন্ত্রীর অফিস ১০ ডাউনিং স্ট্রিট থেকে এটাকে ‘সেক্সড আপ’ করা হয়েছিল। তাতে জড়িত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার নিজে, জ্যাক স্ট্র ও অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল।

No comments

Powered by Blogger.